সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনাকে দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন বিচারক।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম মঙ্গলবার এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেছেন, এ অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত, তবে আইনে বাধ্যবাধকতা থাকায় আসামিদের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে।
রায়ে হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন এবং ৮ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
রায়ে বলা হয়, “এ মামলার ঘটনা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিষ্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধীরা দেশের, জনগণের আমানত, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ অবস্থায় অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িতদের যাবজ্জীবন কারদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।”
এ রায়কে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজার রায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অর্থ কেলেঙ্কারির এত বড় ঘটনা একটি বড় ব্যাপার। এটি শুধু অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে না। এটি দেশের সার্বভৌমত্বকে নষ্ট করে দেয়। ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এই প্রথম এতো বড় রায় এল।”
কোন মামলা
সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের মালিক, কর্মকর্তা ও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। তারই একটি মামলায় আদলত মঙ্গলবার রায় দিল।
গত ২৮ জানুয়ারি মামলার যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আদালত রায়ের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ঠিক করে। তবে ওইদিন মামলাটি তুলে আরও দুই জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে আদালত তা মঞ্জুর করে। এরপর দুই ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। গত ১২ মার্চ দুদক ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ১৯ মার্চ ঠিক করা হয়।
অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলা করে দুদক।
অভিযোগে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে হল-মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা।
এ মামলার তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১ মামলায় হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর, তার ভায়রা তুষারসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। পরে আদালত ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। বিচার চলাকালীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হওয়ায় ১৭ আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে আদালত।
রায়ে যাদের সাজা
রায়ে আদালত হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।
এছাড়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে তানভীর ও জেসমিনকে ৫ কোটি টাকা করে অর্থদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪২০ ধারার অধীনে ৭ বছর কারাদণ্ডের সঙ্গে ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত।
যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া অন্যরা হলেন- সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখার সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, হল-মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিযা, প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান।
এই সাত আসামিকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ৪২০ ও ১০৯ ধারায় সাত আসামিকে ৭ বছরের কারাদণ্ডের সঙ্গে প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত।
এছাড়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সফিউদ্দিন আহম্মেদ, মো. কামরুল হাসান খানকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারার অধীনে তাদের প্রত্যেককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আর আসামি মো. জামাল উদ্দিন সরকারকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অধীনে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারার অধীনে তাকে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত।
আসামিদের মধ্যে জামাল উদ্দিন ও আলতাফ হোসেন জামিনে রয়েছেন। আর পলাতক আছেন সাইফুল ইসলাম, আবদুল মতিন, হুমায়ুন কবির, গোপাল নাথ, তসলিম, সাইফুল হাসান, মেহেরুন্নেসা ও জাকারিয়া। আর কারাগারে আছেন তানভীর, তুষার, জেসমিনসহ আটজন।