হামাসের প্রতিষ্ঠা
আরবি শব্দ হামাসের অর্থ উদ্যম, উদ্দীপনা বা প্রবল উৎসাহ। হামাসের পুরো নাম ‘হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া’। বাংলায় যার অর্থ- ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন। হামাসের জন্ম ১৯৮৭ সালে, ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণমুক্তি সংগ্রামের সময়। প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। গাজার ধর্মীয় নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিন এবং তার সহযোগী আব্দুল আজিজ রানতিসি এর প্রতিষ্ঠাতা।
ইয়াসিন ছিলেন গাজায় বসবাসকারী একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী। তার পরিবারের আদি নিবাস ছিল ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে মাজদাল জেলার আল জৌরা গ্রামে। তার জন্মস্থান বর্তমানে ইসরায়েলের আশকেলন (আসকালান) শহরের অংশ। জৌরা গ্রামে ১৯৩৮ সালে জন্ম হয় শেখ আহমদের। তার জন্মের দশ বছর পরই প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। ১৯৪৮ সালের সেই যুদ্ধে ইসরায়েল তাদের গ্রাম ও বাড়িঘর দখল করে নেয়। প্রাণ বাঁচাতে তার পরিবার গাজায় পালিয়ে আসে। মাত্র ১০ বছর বয়সেই ভিটেমাটি হারা হন শেখ আহমদ ইয়াসিন।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার বছরই ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৭৭% ভুমি দখল করে নেয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইসরায়েলকে ৫৫% আর ফিলিস্তিনকে ৪৫% ভুমি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আরবরা সেটা মেনে নেয়নি। তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। তবে ইসরায়েলিরা প্রস্তাবটি লুফে নেয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আরবরা ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। সংঘটিত হয় ১৯৪৮ সালের প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। যুদ্ধে ইসরায়েল ৭৭% ভুমি দখল করে নেয়। গাজা, পশ্চিম তীর এবং পূর্বজেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ যায় মিশর ও জর্ডান-সিরিয়ার হাতে। ফলে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠা হয়নি।
গাজা থেকে ১৯৫৯ সালে শেখ ইয়াসিন পড়ালেখার উদ্দেশ্য নিয়ে মিশরে যান। সেখানে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা দিয়ে প্রভাবিত হন। পরে গাজায় এসে সেসব চিন্তাভাবনা প্রচার করেন। ১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল গাজাসহ ফিলিস্তিনের বাকি ভূখণ্ডও দখল করে নেয়। এর ছয় বছর পর ১৯৭৩ সালে শেখ ইয়াসিন মুজামা আল ইসলামিয়া নামের একটি দাতব্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা। সেখান থেকেই পরে হামাস গঠন করেন তিনি। মুজাহিদিন আল-ফিলিস্তিন, আল-মুজাহিদিন আল-ইসলামি নামের দুটো সংগঠনও হামাসে যোগ দেয়।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস মিশরের ইসলামি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। পরে স্বাধীন ফিলিস্তিনি সংগঠন হিসেব আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৭ সালে হামাস মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গেও কার্যকরভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে। প্রথমে মূলত দাতব্য ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল হামাস। পরে, ১৯৯১ সালে ইজ্জ আল-দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক শাখাও গঠন করে। সিরিয়ার বাসিন্দা ইজ্জ আল-দিন আল-কাসসাম ছিলেন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতা। তিনি ১৯১৯-২০ সালে সিরিয়ায় ফরাসিদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে পরাজিত হন। পরে ফিলিস্তিনে এসে বসবাস শুরু করেন। ফিলিস্তিনে এসে তিনি ব্রিটিশ এবং যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশরা তাকে হত্যা করে।
হামাস প্রতিষ্ঠার পটভুমি
১৯৮০-র দশকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ইসরায়েল গাজায় তার দখলদারত্ব আরও জোরদার করে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। এমন পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন ধরনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন তৈরি হয়। ১৯৭০-এর দশকে আরব বিশ্বে নতুন ধরনের ইসলামি জাগরণ শুরু হয়েছিল। সেই জাগরণের ফলেই ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগণের মধ্যেও ইসলামী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
হামাসের প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। হামাসের সশস্ত্র কার্যকলাপের ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
হামাস গাজা উপত্যকায় সামাজিক ও মানবিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হামাস শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে। হামাসের সামাজিক ও মানবিক সেবা প্রদানের কর্মকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
হামাসের আদর্শ
আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, হামাস নিজেকে ‘ফিলিস্তিনের ইসলামি জাতীয় মুক্তি ও প্রতিরোধ আন্দোলন’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তারা। ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক ইসলামের সমন্বয়ে গড়ে উঠে হামাসের আদর্শ। হামাসের অনুসারীরা ধর্মের দিক থেকে কট্টর সুন্নি। তারা ইসলামের সুন্নি ব্যাখ্যা মেনে চলে। তাই হামাস ইসলামি শরিয়া আইনভিত্তিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চায়।
হামাসের লক্ষ্য
হামাসের লক্ষ্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্র হবে একটি ইসলামি রাষ্ট্র। যার সীমানা হবে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভূখণ্ডসহ পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড। তবে আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, ২০১৭ সালে হামাস ঘোষণা দেয়, জাতিসংঘ প্রস্তাবিত ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগের সীমানা অনুযায়ী আপাতত একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও তারা তা মেনে নিবে। এতে হামাস সমর্থকদের মধ্যে ভয় জাগে যে, হামাস হয়ত ইসরায়েলকেও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। তখন হামাস ঘোষণাপত্রে আরেকটি ধারা যুক্ত করে। এতে বলা হয়: “হামাসের মূল লক্ষ্য জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত পুরো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকেই দখলমুক্ত করা। এর কোনো বিকল্প মেনে নেওয়া হবে না। তবে, আপাতত ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি আমরা। একে আমরা সব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ‘জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উপায়’ হিসেবে দেখছি।”
হামাস মনে করে, ইসরায়েল একটি অবৈধ রাষ্ট্র এবং এটিকে বলপূর্বক বিতাড়িত করা প্রয়োজন। কারণ, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজেদের ভূমি থেকে উৎখাত করেছে এবং তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার কেড়ে নিয়েছে। হামাস বিশ্বাস করে, ইসরায়েলকে বলপূর্বক বিতাড়িত করা ছাড়া ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও অধিকার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।
হামাসের নেতৃত্ব
রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য হামাসের আলাদা আলাদা নেতৃত্ব রয়েছে। তবে সাধারণ নীতি নির্ধারণ করে একটি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বা পলিটব্যুরো। এটি ৭০-১০০ সদস্য নিয়ে গঠিত। কেন্দ্রীয় কমিটির নিচে রয়েছে গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরো এবং পশ্চিম তীর রাজনৈতিক ব্যুরো। গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরো গাজা উপত্যকার হামাস শাখার দায়িত্বে রয়েছে। পশ্চিম তীর রাজনৈতিক ব্যুরো পশ্চিম তীরের হামাস শাখার দায়িত্বে রয়েছে। হামাসের সামরিক শাখা, ইজ্জ আল-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাসসাম ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ দেইফ। ইসরায়েলে গত ৭ অক্টোবরের হামলার মাস্টারমাইন্ড বলা হয় তাকে।
হামাসের বর্তমান শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া। ২০১৭ সালে খালেদ মেশালের হাত থেকে হামাসের নেতৃত্ব নেন ইসমাইল। খালেদ মেশাল হামাসের নেতৃত্বে আসেন ২০০৪ সালে। সে বছরের ২২ মার্চ ইসরায়েলের এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিন নিহত হন। একই বছরের ১৭ এপ্রিল আব্দুল আজিজ রানতিসিকেও হত্যা করে ইসরায়েল।
এরপর থেকে হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্যরা আর ফিলিস্তিনে থাকেন না। হামাসের বর্তমান নেতা ইসমাইল হানিয়া ২০২০ সাল থেকে কাতারে থাকেন। এর আগে তিনি সিরিয়ায় ছিলেন। খালেদ মেশালও সিরিয়ায় থেকে হামাসের নেতৃত্ব দিতেন। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি অংশ সরকারবিরোধী আরব বসন্তের গণজাগরণে অংশ নেয়। যে কারণে সিরিয়ার সরকার হামাস নেতৃত্বকে সিরিয়া থেকে বের করে দেয়। তুরস্কেও হামাসের কার্যালয় রয়েছে। হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশ তুরস্কেও অবস্থান করছেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের যুদ্ধ
১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই হামাসের যাত্রা শুরু হয়। হামাস ফিলিস্তিনিদেরকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলাসহ সবধরনের উপায়ে হামলায় উৎসাহিত করে আসছে। হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালায় ১৯৮৯ সালে। ইসরায়েল সীমান্ত থেকে দুজন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ করে হামাস সদস্যরা। এরপর ইসরায়েল হামাস নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে ছাড়া পান শেখ ইয়াসিন।
গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক সদস্যের মুক্তির বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। মোসাদের ওই সদস্যকে হামাস আটক করে জর্ডান থেকে। জর্ডানে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান খালেদ মেশালকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ওই মোসাদ সদস্য। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় থেকে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলাও শুরু করে। আর ২০০১ সাল থেকে শুরু হয় হামাসের রকেট হামলা। হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েলও গাজায় নিয়মিত বিমান হামলা এবং স্থল অভিযান চালায়।
হামাসের সশস্ত্র কার্যকলাপের ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরও রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে। ইসরায়েল প্রায়ই হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়, যার ফলে অনেক ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়। হামাসের উত্থান ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। হামাস এখন ফিলিস্তিনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি।
নির্বাচনী রাজনীতিতে হামাস
২০০৫ সালের আগস্ট মাসে ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এর আগে ১৯৬৭ সালে মিশরের কাছ থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর প্রায় ৩৮ বছর ইসরায়েল গাজা দখল করে রেখেছিল। ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করার পর হামাস একটি নির্বাচনী রাজনৈতিক দল হিসেবে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ২০০৫ সালে হামাস গাজার স্থানীয় নির্বাচনে এবং পরের বছর জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও বিজয় লাভ করে। ২০০৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা ইয়াসির আরাফাতের দল ফাতাহকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে। ১৩২ আসনের মধ্যে হামাস পায় ৭৬টি, আর ফাতাহ পায় ৪৫টি আসন। সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ৬৭টি আসন।
নির্বাচনে বিজয়ের পর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন ইসরায়েল স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাস। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলো তাকে মেনে নেয়নি। ইয়াসির আরাফাতের দল ফাতাহ’র সদস্যরাও হামাসকে শাসক দল হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। ২০০৭ সালের জুন মাসে গাজায় হামাস এবং ফাতাহর মধ্যে সশস্ত্র লড়াই বেধে যায়। সেই লড়াইয়ে ফাতাহকে পরাজিত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই লড়াই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এত গভীর বৈরিতা সৃষ্টি করে যে সেই সংঘাতের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এর ফলে ফিলিস্তিনের যৌথ সরকারের বিলুপ্তি ঘটে। ফিলিস্তিনের দুই অংশে ভিন্ন দুটি দল সরকার গঠন করে। গাজা হামাসের শাসনে চলে যায়। আর পশ্চিমতীরে ফাতাহ সরকার।
ইসরায়েল ২০০৭ সালে গাজা ভুখণ্ডের ওপর আকাশ, স্থল এবং সমুদ্র পথে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। হামাস এবং আল কাসসাম ব্রিগেডকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরও কয়েকটি দেশসহ জাতিসংঘও হামাসকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে।
হামাস ও ফাতাহর পার্থক্য
ফাতাহ ফিলিস্তিনের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। ইয়াসির আরাফাত দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হল ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। ফাতাহ ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু হামাস দেয় না। ফাতাহ বিশ্বাস করে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু হামাস মনে করে, ইসরায়েল একটি অবৈধ রাষ্ট্র এবং এটিকে বলপূর্বক বিতাড়িত করা প্রয়োজন।
ফাতাহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৬৭ সালে গৃহীত ২৪২ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষে সম্মতি জানায়। ওই প্রস্তাবে ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই রাষ্ট্র হবে গাজা, পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেমকে নিয়ে। তবে, ফাতাহও প্রথমদিকে হামাসের মতোই ইসরায়েলকে উৎখাত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ১৯৯৩ সালে ফাতাহ সেই লক্ষ্য থেকে সরে আসে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।
অন্যদিকে, হামাস ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। হামাস তাদের ১৯৮৮ সালের প্রতিষ্ঠাকালীন ইশতেহারে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভূখণ্ডসহ পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড মুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। তবে, ২০১৭ সালের একটি ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের সীমানাকে আপাতত একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে স্বীকার করে নেয়। যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। ২০১৭ সালে হামাস আরও ঘোষণা দেয় যে, হামাসের লড়াই সব ইহুদির বিরুদ্ধে নয়, শুধু “দখলদার ইহুদিবাদী হানাদারদের” বিরুদ্ধে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য একটি একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই ভিন্ন। ইসরায়েল স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ফাতাহ। এর বর্তমান নেতা মাহমুদ আব্বাসও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ফাতাহ নিজেদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। একারণে তারা ইসরায়েলিদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও অংশ নিতে পারে। তারা আলোচনাকেই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে, হামাস কোনো ধরনের আলোচনা বা আপসের বিরোধিতা করে সশস্ত্র যুদ্ধকেই একমাত্র উপায় মনে করে।
বিরোধের কেন্দ্রে অসলো চুক্তি
বিশ্লেষকদের মতে, হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির সময় থেকেই। অসলো চুক্তিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অস্থায়ী শান্তি চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পিএলও-র প্রধান রাজনৈতিক দলও ফাতাহ।
এই চুক্তির মাধ্যমেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। বর্তমানে যার সভাপতিত্ব করছেন ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাস। অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার কিছু অংশের উপর সীমিত কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের পুরো অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়েও নিয়ন্ত্রণ পায় ইসরায়েল।
চুক্তিতে আরও বলা হয়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিরাপত্তা ইস্যুতে ইসরায়েলকে সহায়তা করতে হবে। ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যেকোনোও সশস্ত্র হামলা প্রতিরোধেও ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এই ধারাকে অত্যন্ত বিতর্কিত হিসেবে দেখা হয়। হামাস সমর্থকরা একে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা হিসেবে দেখে।
অসলো চুক্তির পর পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং নির্বাসনে থাকা অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা দেশে ফেরার অনুমতি পান। ফিলিস্তিনিদের অনেকেই এই চুক্তিকে একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি অর্জনের সূচনা হিসেবে দেখেন এবং এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
কিন্তু হামাস এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। তারা মনে করে, এই চুক্তির মাধ্যমে “ফাতাহ নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।” এতে হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদন মতে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ওই চুক্তির মাধ্যমে হামাস ও ফাতাহ “পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে” চলে গিয়েছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বিরোধ নিরসনের আর কোনও পথ খোলা থাকেনি। তবে ফাতাহর সঙ্গে হামাস একটি বিষয়ে একমত- ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু হামাস এখনো ইসরায়েল রাষ্ট্রকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ।
ইসরায়েলকে উৎখাতের আগে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ২০১১ সালে হামাস ফাতাহর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছায়। এরপর ২০১৪ সালে তারা একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের চেষ্টা করে। কিন্তু গাজার শাসনভার হস্তান্তর নিয়ে বিরোধের জেরে তা ভেস্তে যায়। তিন বছর পরে, ২০১৭ সালে ফের একটি পুনর্মিলন চুক্তি করে হামাস ও ফাতাহ। ওই চুক্তি অনুযায়ী হামাস গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ফাতাহর হাতে হস্তান্তর করতে রাজি হয়। কিন্তু হামাস সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে বিরোধের জেরে সে চুক্তিও বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর ২০২২ সালে ১৪টি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী আলজিয়ার্সে একটি নতুন পুনর্মিলন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তিতে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার কথা বলা হয়। কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
ফিলিস্তিনিদের চোখে হামাস
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এর গবেষণা প্রতিবেদন মতে, গাজা এবং ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বিভাজন ফিলিস্তিনিদের কাছে বেশ অজনপ্রিয়। ২০২৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, এক তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, এই বিভাজন ফিলিস্তিনিদের জন্য ১৯৪৮ সালের পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ (পিসিপিএসআর) ওই জরিপ চালায়। একই জরিপে আরও দেখা যায় যে, জাতীয় নির্বাচন হলে গাজা এবং পশ্চিম তীরের অর্ধেকের বেশি ফিলিস্তিনি ভোটার হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকেই ভোট দেবেন। অন্যদিকে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনি ভোটার মাহমুদ আব্বাসকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। তার মানে, নির্বাচন হলে ফের হামাস জয়লাভ করবে। কিন্তু মাহমুদ আব্বাস ২০২১ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে রেখেছেন। কারণ, ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদেরকে ভোটে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবে না। তবে পর্যবেক্ষকদের সন্দেহ, আব্বাস হামাসের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকাতেই নির্বাচন স্থগিত করেছেন।
হামাসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
হামাসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জটিল এবং বিভক্ত। হামাসকে অনেক দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে এবং এর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে, মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের কিছু সমর্থক দেশও রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে, হামাস একটি বৈধ রাজনৈতিক দল এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং জাতিসংঘ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। অন্যদিকে, ইরান, তুরস্ক, কাতার, সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসকে বৈধ সংগঠন মনে করে।
তুরস্ক হামাসকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা দেয়। ইরান হামাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগী। ইরান হামাসকে বিপুল পরিমাণ অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এর তথ্য মতে, ইরান হামাসকে বছরে অন্তত ১০ কোটি ডলার অর্থসহায়তা দেয়। কাতারও হামাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগী। কাতার হামাসকে প্রচুর অর্থ সহায়তা দেয়। হামাস নেতাদের এক সময়ের আশ্রয়স্থল ছিল সিরিয়া। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ সরকারের বিরোধীদের সমর্থন দেওয়ায় সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। লেবাননের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ হামাসকে সামরিক সহায়তা দেয়।