গাজায় চলমান যুদ্ধ শেষ করতে করা বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে হামাস সাতজন ইসরায়েলি বন্দিকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) হেফাজতে হস্তান্তর করেছে।
ইসরায়েলে সোমবার হাজার হাজার মানুষ এই মুক্তির দৃশ্য বড় পর্দায় দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় একত্রিত হয়েছিল। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো জানায়, বন্দিরা আইসিআরসির হাতে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে উল্লাসধ্বনি ওঠে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সোশাল মিডিয়া এক্সে জানায়, মুক্তি পাওয়া সাতজন বন্দিকে সেনাবাহিনী ও শিন বেত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনছে। সেখানে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা পরীক্ষা করা হবে।
মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের নাম প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তারা হলেন, মাতান অ্যাঙ্গ্রেস্ট, গালি ও জিভ বারম্যান, আলন ওহেল, আইতান মোর, ওমরি মিরান ও গাই গিলবোয়া দালাল।
ডিপিএ সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনের পর বন্দিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হবে।
জর্ডানের আম্মান থেকে আল জাজিরার নূর ওদেহ জানিয়েছেন, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা “তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছেন, চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই হাঁটছেন।”

একটি নতুন পথ
চুক্তি অনুযায়ী, হামাস ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। তাদের অনেকেই কোনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই আটক রয়েছেন।
একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, যেসব ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে, তারা ইতোমধ্যেই কারাগার থেকে বাসে উঠেছেন।
গাজার খান ইউনুস থেকে আল জাজিরার হিন্দ খুদারি জানিয়েছেন, নাসের হাসপাতালে একটি নির্ধারিত মেডিকেল পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দিদের পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ওই হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন বন্দিদের স্বাগত জানানোর জন্য।
সরকারের মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান রবিবার বলেন, ইসরায়েল আশা করছে সব ২০ জন বন্দিই সোমবার সকালে দেশে ফিরে আসবেন।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ সোমবার জানিয়েছে, বাকি ১৩ জন জীবিত বন্দিকে সকাল ৭টা জিএমটি-তে মধ্য গাজা উপত্যকা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
একজন হামাস সূত্র আল জাজিরা আরবিকে জানিয়েছে, বন্দিদের আইসিআরসিতে হস্তান্তরের আগে গাজা উপত্যকার তিনটি ভিন্ন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েল নিশ্চিত হওয়ার পর যে তার সব বন্দি দেশটির ভেতরে পৌঁছেছে, তখনই ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা আরবি।
মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দি আছেন। তবে বহুদিন ধরে যার মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিনিরা, সেই কারাবন্দি নেতা মারওয়ান বারঘুতি তাদের মধ্যে থাকবেন না বলে ইসরায়েল জানিয়েছে।
কিছু বন্দিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে মুক্তি দেওয়া হবে। সেখানে ইসরায়েল তাদের আত্মীয়দের উদযাপন না করতে এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে নির্দেশ দিয়েছে।
বেদ্রোসিয়ান আরও জানান, ইসরায়েল ২৮ জন বন্দির মরদেহ গ্রহণের প্রস্তুতিও নিচ্ছে, যাদের বন্দিদশায় মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
রবিবার রাতে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দিতে গিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি আশা করেন বন্দিদের মুক্তি দেশের জন্য ঐক্যের মুহূর্ত হয়ে উঠবে। যদিও যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে তাকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, “এটি এক আবেগময় সন্ধ্যা… কারণ আগামীকাল আমাদের সন্তানরা নিজেদের সীমান্তে ফিরে আসবে। আগামীকাল একটি নতুন পথের সূচনা; পুনর্গঠনের পথ, আরোগ্যের পথ, এবং আমি আশা করি, ঐক্যের পথ।”
তবে কিছু বন্দির পরিবারের সদস্য নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছেন। অভিযোগ করেছেন যে, তিনি তাদের প্রিয়জনদের মুক্তির চেয়ে সামরিক জয়কেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
শনিবার যখন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ তেল আবিবে এক সমাবেশে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন, তখন অনেকেই তাকে উদ্দেশ করে বিদ্রুপ করেন।

ট্রাম্পের খেলা
বন্দি বিনিময় কার্যক্রমটি শুরু হচ্ছে ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদনের তিন দিন পর। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিশরের সম্মেলনের আগে ইসরায়েল সফরে যাচ্ছেন।
রবিবার বিকেলে ওয়াশিংটন ডিসির কাছে জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রুজ থেকে ট্রাম্প ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার সঙ্গে বিমানে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যুদ্ধমন্ত্রী পিট হেগসেথ ও সিআইএ প্রধান জন র্যাটক্লিফ।
বিমানে ওঠার আগে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “এটি একটি বিশেষ মুহূর্ত হতে যাচ্ছে… সবাই উচ্ছ্বসিত।”
এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ট্রাম্প জানান, বন্দিরা “সম্ভবত কিছুটা আগেভাগেই মুক্তি পেতে পারেন”, তার নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, এবং কাতারকে কৃতিত্ব দেওয়া উচিত মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য।
“যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তোমরা এটা বুঝতে পারছো,” তিনি আরও বলেন।
আল জাজিরার প্রতিবেদক নূর ওদেহ। তিনি ইসরায়েলে আল জাজিরা নিষিদ্ধ থাকায় জর্ডানের আম্মান থেকে প্রতিবেদন দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “এটি ট্রাম্পের শো। তিনি ইসরায়েলে পৌঁছে বন্দিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন, কনেসেটে ভাষণ দেবেন, এবং তারপর মিশরের শারম আল-শেখে যাবেন। সেখানে তিনি ২০টিরও বেশি দেশের নেতাদের আহ্বান করেছেন।”
ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার কিছু অংশ (গাজা সিটি ও উত্তরাঞ্চল) থেকে সরে গেছে। যদিও তারা এখনও এলাকার অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
আল জাজিরার ইব্রাহিম আল-খালিলি গাজা সিটি থেকে জানিয়েছেন, যেসব ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরে ফিরেছেন, তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখছেন। তাদের পাড়াগুলো এখন “উজাড় ভূমিতে” পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে মানবিক সাহায্য গাজায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে। রবিবার ডজনখানেক ট্রাক প্রবেশ করেছে। তবে আল জাজিরার হিন্দ খুদারির মতে, দীর্ঘ মাসের চরম দুর্দশার পরও সাহায্য বিতরণ প্রক্রিয়া এখনও ধীরগতির।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ থেকে তিনি বলেন, “মানুষ কেবল খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে না, তারা অপেক্ষা করছে তাঁবু, চলমান আশ্রয়কেন্দ্র, সোলার প্যানেল, এবং জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের জন্য। এগুলোর অভাব গত দুই বছর ধরে। অধিকাংশ মানুষের সঞ্চয় শেষ। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।”

নেতারা মিশরে সম্মেলনে
গাজার এই সম্মেলন সোমবার মিশরের শারম আল-শেখে অনুষ্ঠিত হবে। এর সহ-সভাপতিত্ব করবেন ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি।
সম্মেলনে অংশ নেবেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয় এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানসহ এক ডজনেরও বেশি বিশ্বনেতা।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, তিনি কিংবা ইরানের প্রেসিডেন্ট কেউই সম্মেলনে যোগ দেবেন না। কারণ তারা এমন নেতাদের সঙ্গে “সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না, যারা ইরানি জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা উল্লেখ করেন।
ইসরায়েল ও হামাস এই সম্মেলনে অংশ না নিলেও কায়রো একে “ঐতিহাসিক” ইভেন্ট হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের আশা, এটি “গাজা উপত্যকার যুদ্ধের সমাপ্তি, এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা জোরদার করবে।”
মিশর জানিয়েছে, সম্মেলনে “গাজা উপত্যকার যুদ্ধের অবসান ঘোষণা করে একটি দলিল” স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কঠিন কাজ বাকি
যুদ্ধবিরতিতে অগ্রগতি হলেও, দ্বিতীয় ধাপের বহু বিবরণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা প্রশাসনের কাঠামো ও হামাসের ভবিষ্যৎ।
দ্বিতীয় ধাপে ধীরে ধীরে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, নতুন নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থা গঠন এবং পুনর্গঠন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আদনান হায়াজনেহ আল জাজিরাকে বলেন, “আগামীকাল ট্রাম্পের জন্য বড় দিন, বন্দিদের মুক্তির পর আসল কাজ শুরু হবে। গাজার অবস্থা এমন যেন ভূমিকম্পে সব কিছু মাটিতে মিশে গেছে… সেখানে কোনও সরকার নেই, কোনও স্কুল নেই, কিছুই নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স রবিবার স্বীকার করেছেন যে, স্থিতিশীলতার পথ কঠিন হবে। তিনি সিবিএসকে বলেন, “এই স্থিতিশীলতা আনতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পুরো প্রশাসনের ধারাবাহিক চাপ ও তদারকি প্রয়োজন হবে।”

এবিসিকে দেওয়া আলাদা এক সাক্ষাৎকারে ভান্স বলেন, ইসরায়েলে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য যে ২০০ মার্কিন সৈন্য পাঠানো হচ্ছে বলে খবর রয়েছে, তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য নেই। তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মোতায়েন হবে না।
“গাজা বা ইসরায়েলে মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা পাঠানোর কোনও পরিকল্পনা নেই, এটি আমাদের উদ্দেশ্য নয়,” বলেন ভ্যান্স।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা।



