মানুষ নানা কারণে হারিয়ে যায়। কাউকে কাউকে উদ্ধার করতে মাঠে নামা লাগে। আমাকেও অনেকবার এই কাজে লাগতে হয়েছে। আজ ঐরকম তিনটা কেইসের কথা বলছি।
২.
এক বন্ধুর মা ফোন করে জানায় যে উনার ছেলে, আমার বন্ধু, দুই দিন ধরে নিখোঁজ। কোনও ফোন করেনি, অন্যরাও জানে না কই। জাসদ কর্মী। এই অবস্থায় আর কোনও উপায় নাই। তাই বাধ্য হলাম ওকে খুঁজতে যেতে। বাবার গাড়িতে, ভাই চালক আর মা’কে নিলাম সাথে, কারণ উনাকে দেখলে পুলিশের আমাদের বেকসুর ভাবার সম্ভাবনা বেশি। ইউনিভার্সিটি মসজিদের কাছে গিয়ে বুঝলাম কোনও ঝামেলা হয়েছে, প্রচুর পুলিশ। আমাদের গাড়ি থামাল, নামাল আমাকে। আমার গায়ে চাদর, আরও বেশি সন্দেহ। তল্লাশি করল। মা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছেন। শেষে ছেড়ে দিল। আমি হলের গেটে গেলাম, দেখি টং দোকানের সামনে তার দলীয় বন্ধু দাঁড়ানো। কপাল এটাই।
৩.
আমাকে দেখে এগিয়ে এসে জানাল, আমার বন্ধু সূর্য সেন হলে লুকিয়ে আছে। পুরান ঢাকায় তার নামে কেউ কেইস দিয়েছে, সে ঐখানকারই ছেলে। পালাতে পারছে না, কারণ এর মধ্যে কারা যেন ক্যাম্পাসে বোমা ফাটিয়েছে। অতএব আরও বিপদ। তাছাড়া মুজিববাদী ছাত্রলীগের ছেলেরা তো আছেই। আমি বললাম গাড়িতে বের করে নিয়ে যাব। তখন ওই ছেলে ওপরে গেল খবর দিতে। বললাম রোগী সেজে নেমে আসতে। মা জেনেই সাথে গিয়েছিল, তাই এইসব মেনে নিচ্ছেন। বন্ধু এল চাদর-কম্বল জড়িয়ে, কোঁকাতে কোঁকাতে। আমরা ধরে ধরে ওকে গাড়িতে ওঠালাম। তারপর মায়ের গায়ে এলিয়ে পড়তে বললাম কাহিল রোগীর মতো। সে তাই করল।
৪.
ফিরতি পথে পুলিশ আটকাল, কিন্তু রোগী কোঁকাচ্ছে, মাথায় পট্টি, পাশে চিন্তিত বয়স্ক মহিলা, কৌশল কাজে লাগল। তারপর আমরা গাড়িতে হাওয়া। ও আমাদের বাসায় এসে নিজের মায়ের সাথে যোগাযোগ করে, কি সব বলল। কিছু রাগী কথা খরচ হলো। রাতে খেয়ে বাসা ছেড়ে চলে যায়। উদ্ধার করার জন্য মা’কে কৃতজ্ঞতা জানায়। মা থাকতে বলে, কিন্তু আসলে ওর তখন ‘বিপ্লবের’ নেশা—ও তো যাবেই।
৫.
ওদের রাজনীতি শেষ হয় তাহেরের ফাঁসির পর। আর বড় সংগঠন থাকেনি জাসদ। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আমার বন্ধুটি পরে মারা গেছে। ওই বন্ধুর ভাই ওর সম্পত্তি গায়েব করে ফেলে, বন্দুক বুকে লাগিয়ে সব লিখিয়ে নেয়। সে অভিমানে দেশ ছাড়ে। ঘরের শত্রু বড় শত্রু হয়।
৬.
কোনও মেয়েকে বিয়ের জন্য উদ্ধার করাটা অনেক কমন ছিল তখন। হয়ত মাঝে মধ্যে এখনও ঘটে, কিন্তু ছেলে? আমাদের ‘ছেলেকে’ নাকি বাবা-মা আটকে রেখেছে, এদিকে মেয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। মেয়েকে আমি একটু চিনতাম, অনেক স্মার্ট, ছেলে বেশ ভ+ভ+ভ….। তখন মেয়েরা এত সরব হতো না বাবা-মা’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কিন্তু এক বন্ধু যখন যোগাযোগ করে মেয়ের সাথে, সে জানায় কথাটা। বন্ধুরা তো এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেল—‘পোলা উদ্ধার’। আমাকে দলে নেয়। আমার কাজ হবে ছেলের বাবা’কে ব্যস্ত রাখা, মা ঘরে নাই। আমি ভালো স্টুডেন্ট, বাবা তো খুশি হবে আমার সাথে গল্প করতে।
৭.
বাবা পাহারাদার, আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে আড্ডা শুরু করলেন। আমি শুনছি, এদিকে বন্ধুরা হবু জামাইকে নিয়ে পালিয়ে গেল। আমাদের আড্ডা চলছেই, আমার বিরক্তিও বাড়ছেই। কিন্তু করার কিছু নাই। আমিও চালিয়ে যাচ্ছি। জানিও না কী হচ্ছে। শেষে তিনি উঠে একবার ছেলের কাছে গেলেন। ফিরে বললেন, ছেলে বোধহয় একটু বাইরে দোকানে গেছে। আরও আধা ঘণ্টা আলাপ চলে, তারপর ছাড়া পাই।
এর মধ্যে কাজী অফিসে ওদের বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ের খুলনায় পলায়ন ঘটে গেছে। ফিরতে ফিরতে সবাই জেনে গেল বিয়ের কথা। আর তখন তো মানতেই হলো। এমনকি একটা অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়। কিন্তু আমি যাইনি ওর বাবার ভয়ে। আল্লাহ জানে—বকবে না বক বক করবে, আড়াই ঘণ্টা ধরে— সেই ভয়ে।
৮.
আমার খুব নিরীহ এক বন্ধুর ভাইটিও নিরীহ ছিল, কিন্তু নেশাখোর। হঠাৎ দুই দিন মিসিং। বন্ধুটি কাউকে বলতে পারছে না লজ্জায়। শেষে আমাকে বলে। সে নিয়মিত যায় গাঁজার আড্ডায়, হাইকোর্টের মাজার তো আছেই, সাকুরার পিছনে এক মাজার আছে সেখানেও। সেখানে গেলাম খুঁজতে। সাথে নিলাম বন্ধু আমিনকে। ও-ও যুদ্ধে ছিল। কোন পক্ষে জানি না, তবে তখন ‘হালাল দল’ করে। বেশ গুণ্ডা গোছের ছেলে। রেট পঞ্চাশ টাকা। বন্ধুর জন্য ডিসকাউন্ট।
৯.
আড্ডায় জানা গেল টাকা ধারের ঝামেলা চলছে। সেখানে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বাংলাদেশের এক খুব নামী গায়ক, ঝগড়া করছে টাকা নিয়ে। তাকে আর ক্রেডিটে গাঞ্জা দিতে চাইছে না। সে যতই বলে—‘দেব’, আড্ডার মাতবর বলে— ‘ডেট দেন’।
এইরকম যখন চলছে তখন আমিন গেল কাছে, তারপর পরিচয় দিল। মাতবরের মুখ শুকাতে শুরু করে। আমিন বলে, ‘‘…অমুক ভাই পাঠিয়েছে, সালামী কই?’’ মাতবর আমতা আমতা করে বলে, ‘‘আমরা তো মাজার, আমাদের তো সালামী মাফ।’’ আমিন বলে, ‘‘মাজারের সালামী মাফ কিন্তু গাঁজার সালামী কই?’’ সেই লোক কিছু বলার আগে বন্ধুর ভাইয়ের নামটা বলে। আরও ক্রাইসিস। শেষে পিছনের বস্তি থেকে ৩জন বকেয়া গাঞ্জাখোরকে উদ্ধার করা হয়।
আমিন মাতবরকে ধোলাই দিতে চেয়েছিল, আমি বাধা দেই। আমার ইচ্ছা ছিল ভাইটাকে পিটানো। যাই হোক তাকে বন্ধুর কাছে হস্তান্তর করি, পঞ্চাশ টাকাসহ। আমিন ফ্রি’তে কাজ করে দেয়। বলে, ‘‘দোস্ত, সমাজসেবা এতো মজার জানতাম না।’’ সে পরে নয়া সরকারের দলে যোগদান করে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: afsan.c@gmail.com