আসছে নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বদলি খুঁজছেন এখন যুক্তরােষ্ট্রর ডেমোক্রেটরা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে একজন শক্তপোক্ত ব্যক্তি হিসাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে দাঁড় করানো যায় কি না, তা আসছে তাদের ভাবনায়। তবে হ্যারিস অবশ্য বাইডেনের ওপরই আস্থা রাখতে চাইছেন।
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে প্রার্থী বদলানোর মতো পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে নিকট অতীতে দেখা যায়নি। তার ওপর বর্তমান প্রেসিডেন্টকে বদলে ফেলার মতো ঘটনা তো নয়ই।
এমনটা হওয়ার কথাও ছিল না। ডেমোক্রেটদের প্রাইমারিতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেই প্রার্থী করার পক্ষে সমর্থন এসেছিল। কিন্তু পক্ষকাল আগে প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের ম্রিয়মান বাইডেনকে দেখে এখন ডেমোক্রেট শিবিরে প্রার্থী বদলের আওয়াজ উঠেছে।
গত ২৭ জুনের ওই বিতর্কে ৮২ বছর বয়সী বাইডেনের অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তার সামর্থ্য নিয়ে আগেও কারও কারও প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্পের সামনে তার নাজুক দশা সেই সংশয়ে যেন পূর্ণতা দিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গতবার ট্রাম্পকে হারিয়ে আসা বাইডেন বিতর্কে প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থির ও ধারাল বক্তব্যের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বাইডেন। নিজের অবস্থান টেকাতে উত্তেজিত হয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণও করছিলেন।
অন্যদিকে, বাইডেনের উত্তেজিত কথার জবাব বেশ মেপে মেপেই দিচ্ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, প্রথম বিতর্কে বাইডেনের হার মানে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়া। এতে খোদ ডেমোক্রেট শিবিরের অধিকাংশই বাইডেনের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের সম্ভাবনা নিয়ে ডেমোক্রেটদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বাইডেনকে একবার প্রার্থী হিসেবে রাখা উচিৎ কি না, কয়েকজন ডেমোক্রেট নেতা প্রকাশ্যেই এমন প্রশ্ন তুেলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় পর্ষদও এক বিবৃতিতে বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতারা এবং নির্বাচনী প্রচার দলের কর্মকর্তারাও বাইডেনকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
এরপর গুঞ্জন ওঠে, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বাইডেন। তার জায়গায় ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভোটের মাঠে ট্রাম্পের মুখোমুখি হবেন।
তবে গত বুধবার বাইডেন ঘোষণা দেন, তিনি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না এবং প্রার্থিতাও প্রত্যাহার করবেন না।
এর মধ্যেই বিবিসি খবর দেয়, গত বুধবার দুপুরে হোয়াইট হাউসে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বাইডেন।
এরপর ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচার দলকে বাইডেন পরিষ্কারভাবে জানান, ভোটের মাঠে তিনি থাকছেন। বাইনে বলেন, “আমি ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী। আমার জায়গায় কেউ আসছে না। লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে আমি যাচ্ছি না।”
কমলা হ্যারিসও এসময় তাকে সমর্থন জানান।
রয়টার্স জানিয়েছে, বাইডেন বুধবার কেবল নির্বাচনী প্রচার দলকেই নয়, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেটিক পার্টির গভর্নর ও ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রের সঙ্গে ভার্চুয়ালি ও সামনাসামনি দেখা করেন। তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি উপযুক্ত।
তবে বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ২৪ জনের মধ্যে কেবল ৩ জন গভর্নর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। নিউ ইয়র্ক, মিনেসোটা ও ম্যারিল্যান্ড এই তিন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে ভালো না করলেও নির্বাচনে বাইডেনের পক্ষেই থাকবেন তারা। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সামর্থ্যও তার আছে।
ডেমোক্রেটরা কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করতে চাইলেও হ্যারিস বারবার বাইডেনেই আস্থা রাখতে বলছেন। গত শুক্রবারও বাইডেন ফের তার সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।
এরপর শনিবার কমলা হ্যারিসও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রার্থিতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের পরিবর্তে সবাইকে দ্বিতীয়বার ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরলে সেই বিপদের দিকে মনোযোগ ফেরানোর কথা বলেন।
এদিন তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের আবারও বাইডেন-হ্যারিসকে জয়ী করার জন্য ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
৬০ বছর বয়সী হ্যারিস শনিবার নিউ অরলিন্সের এসেন্স ফেস্টিভ্যালে বলেন, “এবারের নির্বাচন সম্ভবত আমাদের জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন।”
কারণ হিসাবে হ্যারিস বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হলে প্রথম দিন থেকেই তার স্বৈরশাসক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন।
এসেন্স ফেস্টিভ্যাল কৃষ্ণাঙ্গদের একটি বার্ষিক সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক উৎসব। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বাইডেনের সমর্থন পুনরুজ্জীবিত করতে বাইডেনের প্রচার শিবিরের চেষ্টার অংশ হিসেবে হ্যারিস এতে যোগ দেন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের জয়ের পেছনে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন সহায়ক ভুমিকা পালন করেছিল।
হ্যারিস উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের এবারের নির্বাচনেও বাইডেনকে ভোট দেওয়ার জোরালো আহ্বান জানান।
সিএনএন এর বুথ ফেরত জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে বাইডেন পেয়েছিলেন ৮৭ শতাংশ ভোট, আর ট্রাম্প পেয়েছিলেন মাত্র ১২ শতাংশ।
তবে ট্রাম্প সম্প্রতি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তার সমর্থন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা কলেজের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব রাজ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে সেসব রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ২০ শতাংশের বেশি ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন।
ভেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত যদি ট্রাম্পের প্রতি কৃষ্ণাঙ্গদের এই সমর্থন অটুট থাকে ট্রাম্পের জয়ী হওয়া সহজ হবে।
ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেকেও বাইডেন সরে দাঁড়াক, তা চায় না। কারণ তাদের বিশ্বাস, বাইডেন প্রার্থী থাকলে ট্রাম্পের জয়ী হওয়া সহজ হবে।
তবে কমলা হ্যারিস বাইডেনের পাশে থাকছেন। এই সপ্তাহের শুরুতে সিএনএন জানায়, বাইডেনকে সরানোর জন্য আসা বেশিরভাগ কল এবং টেক্সট মেসেজ ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছেন হ্যারিস। তিনি বারবার বলেন যে তিনি বাইডেনের পাশেই থাকতে চান।
শুধু কমলা হ্যারিসই নন, আরও অনেকেই বাইডেনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। শনিবারের অনুষ্ঠানে ওহাইয়ো থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেট এমপি জয়েস বিটি বলেন, একটি মাত্র বিতর্কে হারের কারণেই বাইডেনেকে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
“আমাদের সবার জীবনেই খারাপ দিন ছিল। প্রেসিডেন্টের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সেখানে ফিরে যাবেন না।”
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি ম্যাক্সিন ওয়াটার্স জোর দিয়ে বলেন, “বাইডেন কোথাও যাচ্ছেন না।”
তিনি হ্যারিসকে সমর্থন করবেন কি না- প্রশ্ন করা হলে ওয়াটার্স বলেন, “আমরা বাইডেনের উপরই ফোকাস করছি। আমরা মনে করি, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি গত চার বছর সফল ছিলেন এবং তিনিই আবারও প্রেসিডেন্ট হবেন।”
তবে উৎসবে অংশগ্রহণকারী অনেক দর্শক সিএনএনকে বলেন, তারা মনে করেন বাইডেন সরে দাঁড়ালে হ্যারিস নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটাররা বলেছে যে, তারা নভেম্বরে ডেমোক্রেট মনোনীত যে কোনও প্রার্থীর পক্ষেই তাদের ভোট দেবেন।
নিউ অরলিন্সের বাসিন্দা জেরি পেরিস বলেন, “নির্বাচনী টিকেট যেভাবে আছে, সেভাবেই রাখুন। কমলা হ্যারিসের সময়ও আসবে। খেলার মূল পরিকল্পনায় অটল থাকুন। যে পরিকল্পনা ছিল, সেটাতেই লেগে থাকুন। পরিকল্পনা আগেও কাজ করেছে; এবারও আবার কাজ করবে।”
পেরিস বলেন, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিতর্কে বাইডেন মাত্র একবার খারাপ করেছেন। সকলেই অসুস্থ হয়। তিনি একজন ভালো প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন ভালো মানুষ। তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। সবারই ছুটির দিন আছে।
অন্যদিকে ওয়াশিংটন ডিসি’র লরা মরগান রবার্টস বলেন, “ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সক্ষমতা, প্রতিশ্রুতি, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছার উপর আমার ১০০ শতাংশ আস্থা আছে।”
টেনেসির ভোটার মিশেল বাক্সটন সিএনএনকে বলেছেন, “মনে হচ্ছে তারা বাইডেনকে সুযোগ দিতে চাচ্ছে না।
“আমরা এখানে সবাই একসঙ্গে কাজ করছি এবং আমার কাছে এটি প্রায় ব্যক্তিগত বলে মনে হচ্ছে। আমি মনে করি না যে, তাকে নামিয়ে আনা উচিৎ হবে।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন