কলকাতার ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে কীভাবে নেওয়া হয়, কীভাবে হত্যা করা হয়, তা সবিস্তারে জানালেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।
সেখানে হত্যাকাণ্ডে সাতজন ছিলেন জানিয়ে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তারের কথাও বলেছেন তিনি। তবে কী কারণে এই সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নন তিনি। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, খুনের কারণ অনুসন্ধানে তাদের তদন্ত চলছে।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনার গত ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পরদিনই কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন বলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ২২ মে জানায়। তার লাশের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ বলছে, হত্যার পর আনারের দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে।
সঞ্জিবা গার্ডেন্সের সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার হয়েছে। তা আনারের দেহাংশ কি না, তা জানতে এই সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ডিএনএ নমুনা নিয়ে মিলিয়ে দেখা হবে। সেজন্য ডরিনের কলকাতায় যাওয়ার কথা রয়েছে।
আনারের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পরপরই ঢাকায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে এই ঘটনার তদন্তে নামা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের দুই নেতাও গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ বুধবার গ্রেপ্তার করা হয় আরও দুজনকে।
এরপরই বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছে পাওয়া তথ্য ও নানা ভিডিও বিশ্লেষণ করে খুনের বিবরণ দেন তিনি।
‘দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন আনার’
আনার ১২ মে স্থলপথে পশ্চিমবঙ্গ যাওয়ার পর উঠেছিলেন বরাহনগরে তার পুরনো বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখান থেকে পরদিন বের হওয়ার পর থেকে তার খোঁজ না পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন গোপাল।
এই খুনের তদন্তভার পাওয়ার পর কলকাতা ঘুরে আসা হারুন বলেন, “১৩ মে সকালে এমপি আনার তার বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হন। সে সময় কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে অপেক্ষায় ছিল ফয়সাল। তিনি আনারকে রিসিভ করে লাল গাড়ির কাছে যান। সেখানে ছিলেন শিমুল ভূঁইয়া।
“অন্যদিকে কলকাতা সঞ্জিবা গার্ডেন্সের ভাড়া বাসায় অপেক্ষায় ছিলেন অন্যতম আসামি মোস্তাফিজ ও জিহাদ হাওলাদার। ফয়সাল ও শিমুল ভূঁইয়া ওই ফ্ল্যাটে আনারকে নিয়ে গেলে রিসিভ করেন শিলাস্তি রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান।”
সঞ্জিবা গাের্ডন্সের ওই ফ্ল্যাটটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি আক্তারুজ্জামান শাহীন ভাড়া করেছিলেন। আনার কেন সেখানে গিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। তবে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. শহীদুজ্জামানের ভাই আক্তারুজ্জামান এক সময় আনারের বন্ধু ছিলেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়।
হারুন বলেন, আনার ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরপরই ভিন্ন কিছু সন্দেহ করেছিলেন।
“তারা এক পর্যায়ে ফ্ল্যাটের নিচে কর্নারের রুমে যান। আসামিদের গতিবিধি নিয়ে আনারের সন্দেহ হলে তিনি সেখান থেকে বের হতে অনেক কাকুতি-মিনতি করেন।”
এমপি আনার একপর্যায়ে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন জানিয়ে হারুন বলেন, “দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হতে গেলে আসামি ফয়সাল তার নাকে মুখে ক্লোরোফর্ম চেপে ধরে। এ সময় আনার নিস্তেজ হয়ে গেলে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করা হয়।
“কলকাতার একটি মার্কেট থেকে আগেই ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে আনা হয়। সঙ্গে আনা হয়েছিল ক্লোরোফর্ম। সেই চেয়ারে বেঁধে আনারকে বিবস্ত্র করা হয়। এই কাজগুলো করেছে ফয়সাল। আর হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সিয়াম এনে দিয়েছিল ফয়সালকে।”
কলকাতা পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, আনারকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছিল। আর এই কাজটি করেছিলেন জিহাদ হাওলাদার নামে আরেক বাংলাদেশি, যিনি পরে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন।
জিহাদ নিয়ে অভিযান চালিয়েই সঞ্জিবা গার্ডেন্সের সেপটিক ট্যাংক থেকে মাংসের কিছু টুকরা উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
‘খুনে জড়িত ৭ জনই গ্রেপ্তার’
আনারকে খুন করতে সাতজন সরাসরি জড়িত ছিলেন দাবি করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, তাদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিবি শুরুতেই গ্রেপ্তার করেছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভুইয়া, তার ভাতিজা তানভির ভূইয়া এবং শিলাস্তি রহমান নামে এক তরুণীকে।
এরপর ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং ওই কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর বুধবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মোস্তাফিজুর রহমান এবং ফয়সাল আলী সাজীকে।
কলকাতায় জিহাদকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি নেপাল থেকে সিয়াম আহমেদ নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করে এনেছে ভারতীয় পুলিশ।
‘কিলিং মিশনে’ সাতজন অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, “সাতজনই গ্রেপ্তার হয়েছে। শিমুল ভূঁইয়ার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডের জন্য যা যা করার দরকার, তারা তাই করেছে। আসামিদের মধ্যে শিমুল ভুঁইয়া, ফয়সাল, মোস্তাফিজুর, তানভীর ও শিলাস্তি রহমান আমাদের হেফাজতে রয়েছে।
“ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদার সেখানে আছে। আর নেপালে আত্মগোপনে থাকা সিয়ামকে আমাদের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারের পর কলকাতায় নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আরও দুজন আসামিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তারা হলেন- ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু ও গ্যাস বাবু।”
হারুন জানান, ঢাকার ডিবির হাতে গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ গ্রেপ্তার ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয় দিনের জন্য রিমান্ডে আনা হচ্ছে।
ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে নিয়ে তিনি বলেন, “এই দুজনকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের একটি টিম ছিল ঝিনাইদহে, সুন্দরবনেও একটি টিম গিয়েছিল। আর দুটি টিম খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ফটিকছড়ি ও সীতাকুণ্ডে কাজ করছিল অনেকদিন ধরে।
“সবদিকে গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে আমরা গতকাল সেই দুজনকে গ্রেপ্তার করি। তারা আত্মগোপনের জন্য ফটিকছড়ি ও সীতাকুণ্ডের মাঝখানে পাতাল কালীমন্দিরে লাল ধুতি পরে অবস্থান করছিল। সেখানে তারা হিন্দু পরিচয়ে লুকিয়েছিল।”
খুনের কারণ এখনও অজানা
ভারতের গোয়েন্দাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছিল, সোনা চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই আনারকে খুনের পরিকল্পনা করেন শাহীন।
তিন বারের এমপি আনারের বিরুদ্ধে চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ আগেও ছিল। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও হয়েছিল।
তবে এটাই আনার হত্যার কারণ কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলেনি ডিবি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এর আগে ইঙ্গিত দেন, স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
কী কারণে আনারকে খুন করা হয়েছে- সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নে হারুন বলেন, “যে কোনও হত্যার পেছনে মোটিভ থাকে। সংসদ সদস্য আনার হত্যায় কারা আর্থিক, রাজনৈতিকভাবে লাভবান, সেটা আশা করি বের হবে। মোটিভ অবশ্যই আছে। সম্ভাব্য সব কারণ আমলে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।”
ডিবির দাবি, আক্তারুজ্জামান শাহিনই সংসদ সদস্য আনারকে খুন করার জন্য শিমুল ভূইয়াকে ভাড়া করেছিলেন।
ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, “তদন্ত শেষ হয়ে যায়নি। শাহীন মাস্টারমাইন্ড ছিল, আছে।
“এখনও আমাদের কাছে শাহীন মাস্টারমাইন্ড। কারণ উনিই তো তার পাসপোর্ট দিয়ে কলকাতার সঞ্জিবা গার্ডেন্সে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিল। হত্যার পরিকল্পনা, বাসা ভাড়া, এ সবই তো শাহীন করেছে।”
খুনের ছক সাজিয়ে শাহীন ১০ মে দেশে ফিরে আবার বিদেশে পাড়ি জমান বলে ডিবি জানতে পেরেছ।
হারুন বলেন, “জিহাদ বাদে হত্যার পর একে একে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সবাই দেশে চলে আসে। একজন নেপালে চলে যায়। শাহীন কিন্তু প্রথমে দিল্লি, এরপর নেপাল তারপর দুবাই হয়ে আমেরিকা চলে যান। তিনি তো ইউএস সিটিজেন। তাকে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে।”