একাত্তরে বাঙালির কাছে যা ছিল মুক্তির দিশা, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই ভাষণ ইউনেস্কোর প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হয়ে এখন বৈশ্বিক দলিল।
এই এক ভাষণ গোটা জাতিকে কীভাবে এক করে তুলেছিল, স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল, তা বিস্ময়ের চোখে দেখেছেন হারুণ হাবীব।
ঐতিহাসিক সেই ভাষণের সাক্ষী এই সাংবাদিক সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, “সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, সাতই মার্চের ভাষণটি রাতারাতি পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছে। অর্থাৎ প্রায় সকলেই মুক্তিবাহিনী হয়ে গেছে ওই এক ভাষণেই।”
জামালপুরের সন্তান হারুণ হাবীব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র। অগ্নিগর্ভ মার্চে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার একেকটি ধাপ দেখছিলেন, ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যুক্তও থাকছিলেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে পাকিস্তানিদের ২৫ বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসানের আশায় ছিল বাঙালি; তবে পাকিস্তানি শাসকরা তা দেয়নি। তখনই ফুঁসতে শুরু করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।
হারুণ হাবীব বলেন, ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি এক অভাবিত গণবিস্ফোরণের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ বসতে যাওয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিতে তাদের অনীহা আগে থেকে দেখা যাচ্ছিল। অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় আন্দোলন নতুন এক মাত্রা পায়।
পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তখন বাঙালির মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। স্বায়ত্তশাসন ছাপিয়ে দাবি হয়ে উঠছিল স্বাধীনতা।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হারুণ হাবীব। পরদিন তিনি দেখেন পল্টন ময়দানে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ।
তারপর অপেক্ষা করতে থাকেন ৭ মার্চের জন্য। এরই মধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কেমন ছিল সেই দিনটি? ৫৩ বছর পরও সেই স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে ৭৬ বছর বয়সী হারুণ হাবীবের কাছে।
বিকালের জনসভার জন্য সকাল ১০টা-১১টার দিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলে দলে মিছিল যাচ্ছিল রেসকোর্সের দিকে, সেই মিছিল নিয়ে যায় হারুণ হাবীবকেও।
সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি এভাবে, “আমরা টিএসসির পাশ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে ঢুকি। মঞ্চের চারপাশ বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে ভেতরে মহিলাদের বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেড়া ডিঙিয়ে আমাদের পক্ষে ভেতরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
“চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়নি কোথাও মানুষের কমতি আছে। মানুষ শাহবাগ ছাড়িয়ে গেছে, টিএসসসি ছাড়িয়ে গেছে, মেডিকেল, প্রেসক্লাব …. প্রত্যেকটা মানুষের হাতে কিছু না কিছু আছে, কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে বৈঠা।”
মাঠে বসে সভয়ে সবাই দেখছিল আকাশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমানের ওড়াওড়ি।
হারুণ হাবীব বলেন, “ভাষণ শুরুর আগেই দেখা গেল, আকাশ দিয়ে স্যাবর জেটগুলো উড়ে যাচ্ছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার উড়ছে।
“সবার মনে একটি আশঙ্কা, যদি বঙ্গবন্ধু এখানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাহলে কি সেই জেট থেকে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হবে? বোমাবর্ষণ করা হবে? এরকম একটি উত্তেজনা ছিল। আরেকটি উত্তেজনা কাজ করছিল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশে কামান বসানো নিয়ে।”
বেলা পৌনে ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে উঠতে দেখলেন হারুণ হাবীব, যার জন্য প্রতীক্ষা ছিল সকাল থেকে।
“পৌনে ৩টার একটু আগে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এসে পৌঁছান। তাকে সেসময় অনেক বিষণ্ন মনে হচ্ছিল। তিনি আসলেন, চশমাটা খুললেন; স্লোগান তখন চারদিকে উঠে গেছে- ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। মানুষের কণ্ঠস্বর দিয়ে তখন খুব স্পষ্ট বেরিয়ে আসছিল স্বাধীনতার দাবিটা। ভাষণে বঙ্গবন্ধু সেসময়ের পাকিস্তানের শোষণ বঞ্চনার কথা তুলে ধরলেন। সর্বশেষ বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম…. মানুষ বুঝলো, উত্তেজিত হল, সারা রেসকোর্স মাঠ কেঁপে উঠল।”
কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি, তবে তার সেই ভাষণ থেকেই সবাই বুঝে যায়, স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এখন।
ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সেদিন প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা না পেয়ে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন হারুণ হাবীবের মতো অনেকে।
হারুণ হাবীব বলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, বঙ্গবন্ধু সরাসরি এই কথাটি বললেন না। ভাষণের পরপরই আমরা একটু বিক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আমরা চাচ্ছিলাম এখনি সরাসরি স্বাধীনতার একটা ঘোষণা দেওয়া হোক।”
উত্তাল মার্চের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন, “৭ মার্চের আগে থেকে মানুষ বুঝে গেছে, তারা (পাকিস্তানিরা) শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তারা কোনও না কোনওভাবে একটা আগ্রাসন চালাবে। ফলে ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রকাশ্যে রিহার্সাল, ট্রেনিং নেওয়া শুরু করে। কারণ সবার মনে মনে ধারণা জন্মেছে পাকিস্তান মরণকামড় দেবে।”
তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অন্তর্নিহিত অর্থ যে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি, তা বোঝা হয়ে যায় অনেকের। হারুণ হাবীবের উপলব্ধিতেও তা আসে।
“কী করে প্রতিরোধ করতে হবে তার নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। গণমানুষের যে মানসিক অবস্থা এই ভাষণের পর থেকে শুধু উত্তেজিত হয়নি, দৃঢ় চিত্ত হয়েছিল। আমাদের মনোজগত তখন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধের মাঠে নামার জন্য।”
বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের সেই ভাষণের তাৎপর্ তুলে ধরতে গিয়ে হারুণ হাবীব বলেন, “বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস, বাঙালিদের উপর নিপীড়ন তুলে ধরেছেন। অতিসম্ভাব্য একটি যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, সেজন্য তার রূপরেখা কী করতে হবে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে হবে, সেটাও তিনি বলেছেন।
“সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার সাতই মার্চের ভাষণটি রাতারাতি পূর্ববাংলা বা পূর্বপাকিস্তানকে একটি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছে। অর্থাৎ প্রায় সকলেই মুক্তিবাহিনী হয়ে গেছে ওই এক ভাষণেই।”
২২ বয়সী হারুণ হাবীবও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তিনি পরিবারের বড় ছেলে, দুই বোন ছোট ছোট। কিন্তু তা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না।
“তখনকার পরিবেশটাই এমন ছিল, কোনও সচেতন তরুণের পক্ষে এর বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না।”
১১ নম্বর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র হাতে লড়েছেন হারুণ হাবীব, চালিয়েছিলেন স্টেনগান। কলম ধরেছেন জয়বাংলা পত্রিকার হয়ে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রণাঙ্গন সংবাদদাতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। রণাঙ্গনে একইসঙ্গে অস্ত্র, কলম ও ক্যামেরা চালানোর বিরল অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
সাংবাদিকতার ছাত্র হারুণ হাবীব স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। প্রবন্ধ, গল্প লেখালেখিতেও সমান সক্রিয় তিনি, পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
বর্তমানে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিবের দায়িত্ব পালনরত হারুণ হাবীব বলেন, “সেই ভাষণের পর থেকে আমাদের মনোজগত তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধের মাঠে নামার জন্য। পরবর্তীতে যে ব্যাপারগুলো ঘটেছে, বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন না শারীরিকভাবে, তবে তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
“সাতই মার্চের ভাষণটি কেবল রাজনৈতিক ভাষণ নয়, একটি মাত্র ভাষণ যেটি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে এবং যার জনক হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান।”