ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও প্রতিরোধ যোদ্ধারা এবার রাশিয়ার সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পাল্টা হামলা শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে তারা রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের প্রায় ১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নেওয়ার দাবি করেছে।
৬ আগস্ট ভোরে কয়েক হাজার সেনা, ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে প্রবেশ করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এখনও রাশিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার দাবি করছে ইউক্রেন।
কুরস্ক ও পার্শ্ববর্তী বেলগোরোড অঞ্চল থেকে রাশিয়া তার লাখ লাখ নাগরিককে সরে যেতে বলেছে। কর্তৃপক্ষ কুরস্ক, ব্রায়ানস্ক ও বেলগোরোড অঞ্চলে ‘ফেডারেল-স্তরের’ জরুরি অবস্থা জারি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনও রুশ ভূখণ্ডের এভাবে আক্রান্ত হওয়ার নজির নেই।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এরপর থেকে দেশটির ভেতরে এই হামলা ইউক্রেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ। একে ইউক্রেনের জন্য এখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও ইউক্রেন এতদিন কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। শনিবার রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিশ্চিত করেন, তার সেনাবাহিনী রাশিয়ার ভূখণ্ডের ভেতরে যুদ্ধ করছে।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর দাবি, তারা রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ভেতরে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে এবং সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেন কুরস্কে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার দাবি করলেও তা নাকচ করে দিয়েছে রাশিয়া।
দেশটির শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল অ্যাপতি আলাউদিনভ বলেছেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, সীমান্ত থেকে ২৬ থেকে ২৮ কিলোমিটার ভেতরে কয়েকটি গ্রামে ইউক্রেনের সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে ৫৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কুরস্কের সুদজা দিয়ে এই আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করার একমাত্র পাম্পিং স্টেশনটি সুদজা শহরে অবস্থিত।
তবে শহরটির নিয়ন্ত্রণ এখন কার হাতে তা স্পষ্ট নয়। গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। কুরস্ক পশ্চিম রাশিয়ায় ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব সুমি শহরের সীমান্তে অবস্থিত।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই অনুপ্রবেশকে ইউক্রেনের ‘বড় আকারের উস্কানি’ বলে অভিহিত করেছেন। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
রাশিয়ায় ইউক্রেনের সামরিক অনুপ্রবেশ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য সত্যিকার অর্থে একটি ‘উভয় সংকট’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
বলা হচ্ছে, রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য করতেই কুরস্কে হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। আকস্মিক এই আন্তঃসীমান্ত হামলা থেকে রুশ ভূখণ্ডকে রক্ষা করতে অবিলম্বে অতিরিক্ত সেনা প্রয়োজন হবে রাশিয়ার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত প্রতিরক্ষামূলক উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য এই অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
তবে গত মে মাসে রাশিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য ইউক্রেনকে সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের কুরস্ক আক্রমণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ বদলে যেতে পারে।
ইউক্রেন কেন এমন হামলা চালাল, তাদের কৌশল কী
পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার আক্রমণের মুখে পিছু হটার পর ইউক্রেন এই পাল্টা হামলা শুরু করে।
অবসরপ্রাপ্ত ফাইটার পাইলট এবং সামরিক বিশ্লেষক শন বেলের মতে, এই হামলার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন নিজেদের উদ্যম ফিরিয়ে আনতে চায়। দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং ইউক্রেন প্রমাণ করতে চায় তারাও রাশিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়তে সক্ষম।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে, রাশিয়া একাই এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করছে না, তাদের হাতেও যুদ্ধের লাগাম রয়েছে।
তবে রাশিয়ার কুরস্কে সেনা পাঠানোর ফলে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান অরক্ষিত হয়ে পড়তে পারে। রাশিয়া ইউক্রেনের আরও অঞ্চল দখল করে নিতে পারে। এ ছাড়া রাশিয়া ইউক্রেনের বাহিনীকে ঘেরাও করার চেষ্টা করতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর এই হামলার কী প্রভাব পড়বে
দুই বছরের তীব্র লড়াইয়ের পর ইউক্রেন কীভাবে এত সহজে রাশিয়ায় আক্রমণ করতে পারল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সামরিক বিশ্লেষক শন বেল আল জাজিরাকে বলেন, এই হামলা যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিতে পারে। সমালোচকরা ইউক্রেনের এই বিস্ময়কর আক্রমণকে বেপরোয়া বলে মনে করলেও “যুদ্ধে গতি ও উদ্যোগই সবকিছু, যা প্রতিপক্ষকে হতবিহ্বল করে দেয়।”
এই আক্রমণ রাশিয়াকে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে বহু সৈন্যকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। ইউক্রেনের দোনেৎস্ক থেকে রাশিয়া অনেক সৈন্যকে সরিয়ে এনে কুরস্কে মোতায়েন করেছে। এতে নিজ দেশের ভেতরের যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেনের ওপর চাপ কমেছে।
তবে আল জাজিরার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস বলেন, কুরস্কে বর্তমান অবস্থান বজায় রাখার জন্য ইউক্রেনকে আরও সৈন্য, ট্যাঙ্ক এবং সরঞ্জাম পাঠাতে হবে।
গ্যাটোপোলোস আরও বলেন, রাশিয়া সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পরাজিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ইউক্রেন যদি অবস্থান ধরে রাখতে পারে তাহলে তারা শান্তি আলোচনায় দুর্দান্ত দর কষাকষি করতে পারবে।
“কিন্তু ইউক্রেনীয় মিশন ব্যর্থ হলে এই ঘটনা তাদের মনোবল বাড়ানোর পরিবর্তে মনোবলের ওপর আঘাত হানবে।”
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী
নিজ সীমান্তের ভেতরে ইউক্রেনের হামলা প্রতিরোধে রাশিয়াও সর্বশক্তি নিয়ে পাল্টা হামলা করেছে। কুরস্কে ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর হামলার পাশাপাশি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভেও বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ান বাহিনী মঙ্গলবার ইউক্রেনের সেনাদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমান দিয়ে পাল্টা আঘাত করেছে। এক সিনিয়র কমান্ডার বলেছেন, এতে ইউক্রেনের অগ্রগতি থামকে গেছে।
রাশিয়ান যুদ্ধ ব্লগাররা কুরস্ক ফ্রন্টজুড়ে তীব্র যুদ্ধের খবর দিয়েছে। তারা জানান, ইউক্রেনীয় সেনারা আরও অঞ্চল দখলের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, রাশিয়া বাড়তি সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নিয়ে আসছে এবং ইউক্রেনীয় আক্রমণ প্রতিহত করছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সুখোই এসইউ-৩৪ বোমারু বিমানের ছবি প্রকাশ করে বলেছে, কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর হামলা চলছে।
রাশিয়ার দাবি, সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধে তারা ইউক্রেনের মোট ৩৫টি ট্যাঙ্ক, ৩১টি সাঁজোয়া যান, ১৮টি পদাতিক যুদ্ধ যান এবং ১৭৯টি অন্যান্য সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে।
চেচেন আখমাত বিশেষ বাহিনী ইউনিটের কমান্ডার মেজর জেনারেল অ্যাপতি আলাউদিনভ বলেছেন, “শত্রুর অনিয়ন্ত্রিত যাত্রা ইতোমধ্যে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। শত্রুরা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে, তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে।”
রাশিয়ার অভিযোগ, ইউক্রেনের এই হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের মদদ রয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, “কোনও সন্দেহ নেই যে, এই অপরাধের সংগঠক ও অপরাধীরা, তাদের বিদেশি মদদদাতারাসহ, দায়ী থাকবে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার পেছনে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জিন-পিয়ের বুধবার বলেন, ইউক্রেনের কুরস্কে হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি।
পুতিন বলেছেন, পশ্চিমারা রাশিয়ার সঙ্গে ছায়া যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকে ব্যবহার করছে। আর সীমান্তে অনুপ্রবেশ রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করার একটি প্রচেষ্টা।
রাশিয়ার ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (এসভিআর) বলেছে, জেলেনস্কি এমন উদ্ভট পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যার ফলে যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের বিশাল এলাকা বর্তমানে রাশিয়ার দখলে।
বেলারুশ কেন ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করছে
রাশিয়ার মিত্র দেশ বেলারুশ শনিবার ঘোষণা করেছে, ইউক্রেন সীমান্তে তারা তাদের বাহিনী পাঠাচ্ছে। তাদের দাবি, কুরস্ক আক্রমণের সময় ইউক্রেন বেলারুশের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে।
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো বলেছেন, বেলারুশের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী পূর্ব বেলারুশের মোগিলেভের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ইউক্রেনের হাজার হাজার ড্রোন ধ্বংস করেছে।
দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভিক্টর ক্রেনিন ঘোষণা করেছেন, ইউক্রেন কর্তৃক বেলারুশের আকাশসীমা লঙ্ঘন একটি উস্কানির ইঙ্গিত। তিনি জানান, বেলারুশও ‘প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত’।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা