অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তী পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। তাকে বলা হতো ঠান্ডা মাথার খুনি। অথচ তার মতো নিপাট ভদ্রলোক গোছের পেসার ক্রিকেটে আর নেই। ভদ্র পেসারদের তালিকা করা হলে হাসান মাহমুদকেও ম্যাকগ্রার পরে রাখা যায়।
নাহ, বাংলাদেশ পেসারকে ম্যাকগ্রার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে না। তবে এই অজি পেসারের একটা গুন ইতিমধ্যে রপ্ত করেছেন হাসান। সেটা হলো, তার মতো নিঁখুত লাইনে বল করার কৌশলটা শিখে ফেলেছেন এই বাংলাদেশী পেসার।
ম্যাকগ্রাকে বল করতে যারা দেখেছেন – সবাই স্বীকার করবেন এই অজি গ্রেট পিচের একটা চ্যানেল ধরে বল করতেন। তার বলে আগ্রাসী শট নিতে গিয়ে কত ব্যাটার যে নিজের উইকেট বিসর্জন দিয়েছেন। তার সঙ্গে লড়াইটা বেশ জমতো গ্রেট ব্রায়ান লারার। অন্যরকম ব্যাটিং স্টান্সে বোলারদের বে-লাইনে বল করতে বাধ্য করতেন এই উইন্ডিজ কিংবদন্তী। কিন্তু ম্যাকগ্রাকে বোকা বানাতে পেরেছেন খুব কমই।
ক্রিকেট ব্যাকরণে টেস্ট বোলিংয়ের আলাদা নিয়ম আছে। “এক জায়গায় বল করা” সেই জায়গাটা হলো অফস্ট্যাম্প থেকে এক স্ট্যাম্প সমান দুরত্বের অংশটা। যাকে বলা হয় পঞ্চম স্ট্যাম্প। গুড লেন্থে বল পিচ করিয়ে ওই লাইনে এক টানা বল কারা। তখন ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাটাররা উইকেটের পেছনে ক্যাচ আউটের ফাঁদে পড়েন।
ম্যাকগ্রা এই ব্যাকরণে বল করতেন। হাসান মাহমুদও এই নিয়ম অনুসরণ করেন। এর সঙ্গে আধুনিকতা যোগ করেছেন বাংলাদেশ পেসার। সেটি হলো – ব্যাটারের ভুলের অপেক্ষায় না থেকে তাকে ভুল করতে বাধ্য করা।
ক্রিকেট এখন আর ম্যাকগ্রার সময়ে নেই। এখন বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে হয়। ওয়াসিম আকরাম যেমন ওভারের ৬ বল ছয় রকম করার রীতিটা চালু করেছিলেন, সেই বুদ্ধি খাটাতে হয়। হাসান ৬ বল ছয় রকম করেন না বটে, কিন্তু এক ওভারে তিন রকম বল করতে পারছেন। অফস্ট্যাম্পের বাইরে বাউন্স, গুডলেন্থ থেকে ইনসুইং ও একই লেন্থ থেকে আউট সুইং। ওভারে তিন রকম বল করছেন বলে সফলও হচ্ছেন।
টেস্টে এখন এক চ্যানেলে বল করে যাওয়াই সফলতা নয়, ব্যাটারকে বোকা বানানোটা সফলতা। হাসান এই জায়গাটায় বাংলাদেশ পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে নিঁখুত হয়ে উঠেছেন।
ভারতের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টে স্বাগতিকদের প্রথম ইনিংসের কথা ধরা যাক। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের চ্যানেলে চমৎকার দুটি ডিলেভারিতে রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলিকে আউট করেছেন হাসান। ওই দুই ডিলেভারিকে বিধ্বংসী বলা যাবে না, তবে চেন্নাইয়ের উইকেটের বিবেচনায় পুরোপুরি নিঁখুত।
রোহিত আউট হওয়ার তিন ওভারের মধ্যে ফিরেছেন কোহলি। দুজনের উইকেট কাছাকাছি ধরনের। ভারত অধিনায়ক ফেরার পর হাসানের ওই ডিলেভারি নিয়ে দারুণ প্রশংসা করেছিলেন রবি শাস্ত্রী।
সাবেক ভারত অধিনায়ক বলেছেন, “হাসান চ্যানেল ধরে বল করতে পারে। সে ব্যাটারদের প্রলুব্ধ করে সামনের পায়ে খেলার জন্য। একটা পেসারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ব্যাটারকে সামনের পায়ে খেলাতে পারলে তার ভুল করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে ড্রাইভ করতে চায় এবং ক্যাচ দেওয়ার ফাঁদে পড়ে। হাসান রোহিতকে সেই ভুল করিয়েছে। ওই বলটিতে রোহিত বুঝতে পারছিল না যে সামনের পায়ে খেলবে না পেছনে। পরে সে সামনের পায়ে খেলতে বাধ্য হলো। এটা হাসানের কৃতিত্ব।”
কোহলির উইকেটও প্রায় একই রকম ছিল। অবশ্য কোহলি ড্রাইভ করতে গিয়ে অনেকবারই উইকেট দিয়েছেন। এবারও দিলেন।
বোলারকে আগে ব্যাটারের দুর্বলতা জানতে হয়। হাসান নিশ্চিত ভাবেই রোহিত-কোহলির অফস্ট্যাম্পের বাইরের চ্যানেলের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছেন। এছাড়া ইনসুইংগারে দুই গ্রেট ব্যাটারের দুর্বলতার কথাও হাসানের জানা। তাই নিঁখুত ভাবে রোহিতকে ইনসুইংয়ে বিট করিয়েছিলেন। অল্পের জন্য তাকে এলবিডব্লিউ আউট করতে পারেননি।
হাসানের এই নিঁখুত বোলিংটা অবশ্য পাকিস্তান সিরিজ থেকেই হচ্ছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খুব একটা উজ্জ্বল ছিলেন না। এর আগে তার ফর্ম নিয়েও সমালোচনা হচ্ছিল। পাকিস্তান সফরে যাওয়ার আগে জাতীয় দলের ক্যাম্পে নিজের বোলিং নিয়ে কাজ করেছেন।
জায়গায় বল করা, ব্যাটারদের সামনের পায়ে খেলতে বাধ্য করা, ইনসুইং-আউটসুইংয়ের সেই কাজগুলো নিঁখুত করে দিয়েছে হাসানকে।