Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

মেট্রোরেলে আগুন-পুলিশ হত্যা : নিজের কথার যে ব্যাখ্যা এখন দিচ্ছেন সমন্বয়ক হাসিব

ডিবিসি নিউজের টক শো ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ এর একটি পর্বে সম্প্রতি আলোচক হিসাবে যোগ দেন হাসিব আল-ইসলাম।
ডিবিসি নিউজের টক শো ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ এর একটি পর্বে সম্প্রতি আলোচক হিসাবে যোগ দেন হাসিব আল-ইসলাম।
[publishpress_authors_box]

‘মেট্রোরেলে আগুন না দিলে কিংবা পুলিশ হত্যা না করা হলে এত সহজে বিপ্লব অর্জন করা যেত না’-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন হাসিব আল ইসলামের এমন বক্তব্য এখন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও তার এই বক্তব্য নিয়ে চলছে আলোচনা। তার এই কথাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার দুটি মেট্রো স্টেশনে আগুন দেওয়া এবং পুলিশ হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি হিসাবেও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ।

এই সমালোচনার মুখে নিজের আগের বক্তব্য থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে এসেছেন হাসিব। তিনি বলছেন, সময়ের স্বল্পতার কারণে তিনি তার কথা শেষ করতে পারেননি বলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিব শুরু থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন। গত ৩ আগস্ট ঘোষিত ১৫৮ বিশিষ্ট সমন্বয়ক টিমে তার নাম ছিল ১৩ নম্বরে।

বেসরকারি টিভি স্টেশন ডিবিসি নিউজের টক শো ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ এর একটি পর্বে সম্প্রতি আলোচক হিসাবে যোগ দেন তিনি। তার সঙ্গে আলোচক ছিলেন বিএনপি নেতা নিলোফার চৌধুরী মনি। শনিবার রাতে ডিবিসি নিউজ ওই আলোচনার ভিডিও তাদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করে।

ওই অনুষ্ঠানেই আন্দোলনের সময় মেট্রো স্টেশনে আগুন এবং পুলিশ হত্যা নিয়ে কথা বলেন হাসিব।

কী বলেছিলেন হাসিব?

রাষ্ট্রপতি অপসারণ নিয়ে চলমান বিতর্কে উপস্থাপক প্রশ্ন রেখেছিলেন- রাষ্ট্রপতির কাছে যখন শপথ নেওয়া হয়েছিল, তখন কী আপস হয়নি?

তার উত্তরে হাসিব বলেছিলেন, “দেখুন, তখন কিন্তু আপস হয়নি। আমরা কিন্তু বলিনি যে, আমাদের যে বিপ্লবটা, যে অভ্যুত্থানটি হয়েছে, সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের যে এক দফার ঘোষণা, সেই ঘোষণাপত্রে আমরা ফ্যাসিবাদের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুরোপুরি বিলোপসহ তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। তখন শুধু ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছিল। বাকি আরও দুটো…তার মানে আমাদের লড়াইটা শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের বিপ্লবটা চলমান।”

এরপরই তিনি বলেছিলেন, “আমরা এটাকে বিপ্লব বলছি বা গণঅভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এটা কোনও সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয়নি, আইন মেনে হয়নি। আইন যদি মানতে যেতাম, তাহলে কিন্তু এই বিপ্লবগুলো হতো না।

“যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো, তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না…ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না। এখানে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পৃথিবীর সকল বিপ্লবই সংবিধান বা নিয়মের বাইরে যেয়ে হয়েছে। এ কারণে আইনের বাইরে যেয়ে বা সাংবিধানিক পদ শূন্য হবে এরকম কথা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কতটা যৌক্তিক সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না।”

গত ১৮ জুলাই আগুন দেওয়া হয় মিরপুর ১০ নম্বর ফুটব্রিজে, সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে মেট্রোরেলে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এই বক্তব্য নিয়ে কেন এত আলোচনা?

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরুর দুই সপ্তাহ পর তা সহিংসতায় গড়ায়। এরপর কয়েকশ মানুষের মৃত্যুতে সেই আন্দোলন গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়, তাতে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।

ওই আন্দোলনের মধ্যে গত ২৮ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর ও কাজীপাড়ায় মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন দেওয়া হয়। তার আগেই শতাধিক আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। সবমিলিয়ে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার একটি তালিকা সম্প্রতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালানোর পর এই আন্দোলন সহিংসতায় গড়ায়।

তার তিন দিন পর নাশকতার দায় অস্বীকার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক (বর্তমানে আহ্বায়ক) হাসনাত আব্দুল্লাহ এক বিবৃতিতে দাবি করেন, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে আন্দোলনকারীদের কেউ জড়িত নয়।

তিনি বলেছিলেন, “আমরা এসবের তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের চলমান আন্দোলনে কেউ সহিংসতা করলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর দায়ভার নেবে না। আমরা সকলকে অনুরোধ করব যাতে আমাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের প্রচেষ্টা না করে। কারণ আমাদের এ আন্দোলন শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবির আন্দোলন।”

তখন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও বিএনপিকে দায়ী করে আসছিল। তারা বলছিল, শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নাশকতা চালাচ্ছে জামায়াত-বিএনপি।

হাসনাতের বিবৃতির পর ২০ জুলাই তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছিলেন, “কোটা সংস্কারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে তারা সংঘাতে জড়িত নন। কাজেই শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষ লাশ চায়।”

এরপর গত ২৯ জুলাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা মেট্রোরেল, বিটিভিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সুপরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে।”

সেদিনই দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “আন্দোলনের সাথে মিশে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত সাধারণ ছাত্রদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।”

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ আগস্ট বলেছিলেন, আন্দোলনের নামে যারা নাশকতা করছে, তারা কেউ ‘ছাত্র নয়’।

তারমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ছাত্রদলের নেতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল।

ডিবি তখন দাবি করেছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা ও ভাংচুর করায়। হামলায় সমন্বয় করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবু হান্নান তালুকদার। আর তাতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইমাম আল নাসের (মিশুক)।

এখন টকশোতে দেওয়া হাসিবের বক্তব্যকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ওই সময়ে সরকারের ভাষ্যের প্রমাণ হিসাবে দেখাচ্ছে। তারা আরও বলছে, সেই কারণেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনও মামলা কিংবা কাউকে গ্রেপ্তার না করে দায়মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে।

হাসিব এখন কী বলছেন?

হাসিব আল-ইসলাম।

টকশোতে দেওয়া বক্তব্য ধরে তুমুল আলোচনার মধ্যে সকাল সন্ধ্যা প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল হাসিবের।

তিনি বলেন, “সময়ের স্বল্পতার কারণে আমি পুরো বক্তব্য শেষ করতে পারিনি। আমি আসলে শর্ট করতে গিয়ে দুই লাইনে শেষ করেছি। তবে যেটা বোঝাতে চেয়েছি, সেটা প্রোপারলি এক্সপ্লেইন করতে পারিনি।”

তাহলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন- জানতে চাইলে হাসিব বলেন, “আমি বলতে চেয়েছিলাম…আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা…ছাত্রলীগরা মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছে। একই সময়ে তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে, আহত করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ছাত্রদের দেখতে হাসপাতাল না গিয়ে মেট্রোরেল ভিজিট করতে গিয়ে মায়াকান্না কেঁদেছে। এই যে নির্দয়তা, সেটি এই দেশের মানুষকে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আরও উৎসাহিত করেছে।”

পুলিশ হত্যা নিয়ে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় হাসিব বলেন, “তখন এই পুলিশ প্রশাসন আওয়ামী সরকারের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হত্যাযজ্ঞ করেছে, তখন মানুষ আরও বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে।

“তাই আমি বলেছি, মেট্রোতে আগুন না দিলে কিংবা পুলিশ না মারলে এই বিপ্লব এত সহজে অর্জন করা যেত না,” বলেন তিনি।

৩১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের এই টকশো’র ঠিক ১৬ মিনিটের মাথায় উপস্থাপকের প্রশ্নে হাসিবের আলোচিত বক্তব্যটি আসে।

এরপর টকশোটি আরও ১৮ মিনিট চলছিল। ওই সময়ে বিএনপির সমালোচনা করেও বক্তব্য রাখেন হাসিব।

টকশোর পরিচিত মুখ বিএনপি নেতা মনি স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ছিলেন এই আলোচনায়ও। সেখানে হাসিবকে দেখা গেছে বেশ রক্ষণাত্মক ভূমিকায়, যিনি ফেইসবুক প্রোফাইলে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ‘রাজনীতিক’।

হাসিব গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটি সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। নাহিদ ইসলামসহ (বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা) সমন্বয়কদের কয়েকজন এই ছাত্র সংগঠনে ছিলেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সংগঠনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক, ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। তিনি এখন ‘অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গঠিত’ জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত