অর্ধ শতাধিক আসনে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আইনসভায় সরকারি দলের অংশ হবেন না, আবার সংসদের বাইরে আওয়ামী লীগের হয়েই কাজ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের পর সংসদের ভেতরে-বাইরে তাদের ভূমিকা নিয়ে এমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বলেছেন, সংসদে ভিন্ন পরিচয়ে এলেও তারা আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান না। প্রধানমন্ত্রীও তাতে সায় দিয়েছেন। তবে সংসদে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়েই থাকতে বলেছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বতন্ত্র পরিচয়ে থাকলেও তাদের ভোট করা নিয়ে যে কোন্দল দলে সৃষ্টি হয়েছে, তা মিটিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে।
দ্বাদশ সংসদে ৬২ আসনে জয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংরক্ষিত নারী আসনের ১০ জন সদস্যকে মনোনীত করতে পারবেন। তারা কারা হবেন, সেই সিদ্ধান্তের ভারও শেখ হাসিনাকেই দিয়েছেন তারা।
বিএনপিবিহীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জমিয়ে তুলতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খুলে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাতে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়ে যান ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যারা সবাই আওয়ামী লীগই করেন।
এই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগে যেমন যোগ দিতে পারত, তেমনি জোট গড়ে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার বিরল সুযোগও তাদের ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার দুদিন আগে রবিবার গণভবনে তাদের আলোচনায় ডাকেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে সাড়া দিয়ে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সবাই। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে আড়াই ঘণ্টা চলে বৈঠক।
গণভবন থেকে বেরিয়ে ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ কে আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা নৌকা পাই নাই। তবে সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে আছে, দায়িত্বে আছে। আমরা তো আওয়ামী লীগেরই লোক।
“আবার আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী, আমাদের কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। আমরা যেহেতু দলের মধ্যে আছি আমাদের একত্রিত করা হোক, ” প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কী জবাব পেয়েছেন, তা জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, “তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, স্বতন্ত্র হিসেবেই তোমরা কাজ কর। এখানে কোনও সমস্যা হবে না। কারণ একটা আমার বাম হাত, এটা আমার ডান হাত। “
পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, “নেত্রী সকলের পরিচয় নিয়েছেন। সকলের কথা শুনেছেন। ৬২ জনই দাবি করেছি, আমরা আওয়ামী লীগেরই লোক। আমরা আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে চলতে চাই।
“প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তোমরা আওয়ামী লীগেরই লোক। আওয়ামী লীগেই আছ। আমরাও মনে করি, আমরা আওয়ামী লীগেই আছি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা সংসদে ভূমিকা পালন করব।”
বিভিন্ন বিলে স্বতন্ত্র এমপিদের কথা বলার সুযোগ বেশি থাকার আশ্বাস পাওয়ার কথা জানান আজাদ। তিনি বলেন, “বিভিন্ন বিলের ওপরে পার্টির নৌকা প্রতীকের তাদের কথা বলার সুযোগ কম থাকবে। স্বতন্ত্র এমপিদের সুযোগ বেশি থাকবে।”
সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ভূমিকা কেমন থাকবে, তা সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তিনিও এই বৈঠকে ছিলেন।
কাদের বলেন, “স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই থাকবেন। তারা সরকারের সমালোচনা করতে পারবেন।”
এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। অন্যবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে বহিষ্কার করত আওয়ামী লীগ। এবার তা না হওয়ায় তার জেরে কোন্দল বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ, অন্তর্কলহ এসব বিষয় রয়েছে। এখনও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও কিছু কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা দেখছি।
“প্রধানমন্ত্রী সবাইকে বলেছেন, এটা আর হতে দেওয়া যাবে না। নিজেরা যখন দাবি করছে, আমরা আওয়ামী লীগই থাকতে চাই, ভিন্ন কোনো নামে পরিচয় দিতে গেলে আমাদের বিবেক এবং আবেগ আহত হয়। সে অবস্থায় নিজেরা নিজেদের মধ্যে যে বিবাদ অন্তর্কলহ এসব মিটিয়ে ফেলতে হবে।”
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন বলে জানান কাদের।
নারী আসন
জাতীয় সংসদে মোট ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৫০টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি ৩০০টি আসনে সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও নারী আসনে তা হয় না।
সরাসরি ভোটে বিজয়ী দল বা জোটের আসন সংখ্যার অনুপাতে নারী আসন বণ্টিত হয়। যে নিয়মে সংরক্ষিত নারী আসনের মোট সংখ্যাকে (৫০) সংসদের মোট আসনের মোট সংখ্যা (৩০০) দিয়ে ভাগ করে তার সঙ্গে গুণ করতে হয় কোনো দল বা জোটের প্রাপ্ত আসনকে। এক্ষেত্রে ফল ভগ্নাংশ হলে নিকটতম পূর্ণ সংখ্যা ধরা হয়।
এই সূত্রে এবার সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হওয়ায় তারা নারী আসন পাচ্ছে ৩৭টি। আর ৬২টি আসনে জয়ী স্বতন্ত্ররা মনোনীত করবেন ১০ জন নারী এমপিকে।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে স্বতন্ত্র এমপি মহারাজ বলেন, “আমরা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা ১০টি আসন পাব। ৬২ জনই একমত হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছি। তিনি তার মতন করে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন প্রদান করবেন।”
স্বতন্ত্রদের কোনও জোট হবে না বলে জানান সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে হারিয়ে আসা এই সংসদ সদস্য।
এ কে আজাদ বলেন, “আমরা নেত্রীকে বলেছি, আপনি যাদের মনে করেন যোগ্য, যার অবদান আছে পার্টির প্রতি, অথচ নমিনেশন পায় নাই, সে সব পরিবারের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদ দেবেন।”
সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদেরও বলেন, “সংরক্ষিত আসনে তারা (স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য) সংসদ নেতা আমাদের সভাপতি শেখ হাসিনা যাদেরকে মনোনীত করবেন, তাদেরকেই সমর্থন দেবেন বলে ব্যক্ত করেছেন।”