পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বে এখন যারা বেঁচে আছেন, তার চেয়ে বেশিবার এই দায়িত্ব কি কেউ পেয়েছেন? খুঁজলে নগণ্য সংখ্যাই মিলবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার সরকার প্রধান হিসেবে যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে ফেরেন তিনি। সে থেকে টানা ১৫ বছর দায়িত্বে রয়েছেন। তার আগের পাঁচ বছর হিসাব করলে ২০ বছর হয়ে গেছে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়া অনুমিতই ছিল। কারণ সংসদে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাদেরই সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি।
বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সেই প্রজ্ঞাপনও এসেছে। তাতে জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আস্থাভাজন হিসেবে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ফলে এখন শেখ হাসিনা তার নতুন সরকার গঠন করবেন। আর নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নেবেন তিনি।
বিশ্বে এখন যারা জীবিত সরকারপ্রধান রয়েছেন, তাদের মধ্যে যে পাঁচজন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজ নিজ দেশে সরকারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার মধ্যে একমাত্র নারী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার সামনে যারা রয়েছেন, সেসব দেশের বেশিরভাগেই আবার গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। যেমন ব্রুনেইয়ে হাসানাল বলকিয়াহ ৪০ বছর ধরে সরকার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তবে দেশটিতে গণতন্ত্র নেই, রাজতান্ত্রিক দেশটিতে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতারোহন ঘটে।
সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনেডিনজে র্যালফ গোনসালভেজ ২২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী পদে আছেন। তবে এই দেশটিতেও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চলে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের ডমিনিকায় রুজভেল্ট স্কেরিট ২০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদে রয়েছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রধানমন্ত্রী হন তিন মেয়াদে, আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে।
বিশ্বের নারী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি দিন এই দায়িত্বে থাকেননি।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৬ বছর ১ মাস। বিশ্বে প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে শ্রীলঙ্কায়। ১৯৬০ সালের ২১ জুলাই দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে। দুই মেয়াদে ১২ বছর সেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পাকিস্তানে বেনজীর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ১৯৮৬ সালে। চার বছর পর তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন। এরপর আবার তিন বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
ইসরায়েলে গোল্ডা মেয়ার ১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন। বিশ্ব রাজনীতিতে ‘আয়রন লেডি’ খ্যাত মার্গারেট থ্যাচার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রিত্বে ছিলেন ১১ বছর।
সেই হিসাবে নারী-পুরুষ সরকার প্রধান মিলিয়ে অনন্য এক অবস্থানে রয়েছেন শেখ হাসিনা।
ভোটে জেতার পর গত ৮ জানুয়ারি নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকরা এনিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে।
জবাবে তিনি বলেন, “এরা অনেক মহীয়সী নারী। আমি একজন সাধারণ নারী, অত শিক্ষা-দীক্ষাও নেই। তবে একটি বিষয়, আমি সব সময় অনুভব করি, আমার দেশের সাধারণ মানুষের জন্য আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আমাকে তাদের সেবা করতে হবে। এটাকে আমি কখনও ক্ষমতায় থাকা মনে করি না।”
বন্ধুর পথ পেরিয়ে
শেখ হাসিনা জাতির পিতার সন্তান হলেও তার চলার পথ কখনও সহজ ছিল না। ছেলেবেলায় বারবার দেখতে হয়েছে বাবাকে কারাগারে যেতে। পঁচাত্তরে পরিবারের সবাইকে হারানোর পর দুর্গম এক পথ পাড়ি দিয়ে তাকে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তখন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
তখন ছয় বছর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের হাল ধরে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন।
রাজনৈতিক সংগ্রামে অনেকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে। মৃত্যুর ঝুঁকিও এসেছে বারবার, কমপক্ষে ১৯ বার তাকে হত্যার জন্য হামলা চালানো হয়েছিল। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হয়েছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা, সেই গ্রেনেড হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণশক্তি হারান তিনি।
১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর প্রথম সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা করেন তিনি।
দ্বিতীয় বার তিনি প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে। এরপর ২০১৪ সাল, ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বরাবরের মতোই গোপালগঞ্জ-৩ আসনে (টুঙ্গীপাড়া-কোটালীপাড়া) বিপুল ভোটে বিজয়ী হন শেখ হাসিনা।
পৈত্রিক এলাকায় নৌকা প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটের সংখ্যার হিসাবে ছিলেন বহু দূরে। বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সেই প্রার্থী এম নিজামউদ্দিন লষ্কর একতারা প্রতীকে পান ৪৬৯ ভোট।
ভোটের এত বেশি ব্যবধানে এবার অন্য কোনো আসনে দেখা যায়নি। ৭৬ বছর পেরিয়ে আসা শেখ হাসিনা এ নিয়ে আটবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হলেন । আবার বসছেন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে।