গত ১ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নেমেছিল, তখন বাংলাদেশে কে ভাবতে পেরেছিল মাত্র ৩৬ দিনে নতুন এক ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।
রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের মধ্যে পতন ঘটল শেখ হাসিনার সরকারের। ভিন্ন ধরনের এক সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নিলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তখন চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার।
গত ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল হলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শুরু হয় নতুন আন্দোলন।
শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ১ জুলাই থেকে মিছিল-সমাবেশ শুরু করে।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগকে কেন্দ্র করেই চলছিল শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। প্রায় প্রতিদিন শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল তারা। ধীরে ধীরে আন্দোলনের পরিসরও বাড়তে থাকে।
তবে আন্দোলন চাঙা হয়ে ওঠে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে। এরপর আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর নীতি নেওয়ার পর সংঘাতে প্রাণ হারায় কয়েকশ মানুষ; তাতে মানুষের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে।
কারফিউ জারি করে, সেনা মোতায়েন করেও তা সামাল দিতে না পেরে গত ৫ অগাস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
এর তিন দিন বাদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঘটনাক্রম
১৪ জুলাই
চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা; এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? (চাকরি) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে?”
সেই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই বিক্ষোভ থেকে স্লোগান ওঠে- ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’।
১৫ জুলাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় ক্যাম্পাসে।
১৬ জুলাই
সারাদেশে আন্দোলনকারী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘাত বাধে। এতে ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়।
রংপুরে নিহত আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পুলিশের গুলির মুখে তার প্রতিরোধের ছবি এই আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
এদিন কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে সরকার।
১৭ জুলাই
সারাদেশে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সেই পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। সর্বোচ্চ আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
তাতে সাড়া না দিয়ে পরদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৮ জুলাই
সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ বাধে। নিহত হয় কমপক্ষে ৪১ জন।
ঢাকায় মেরুল বাড্ডায় একটি ভবনে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে হেলিকপ্টারে করে তাদের উদ্ধার করা হয়।
রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়।
সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও আলোচনার প্রস্তাব নাকচের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।
কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের শুনানি এগিয়ে ২১ জুলাই করার সিদ্ধান্ত হয়।
১৯ জুলাই
সংঘর্ষ ব্যাপক আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নিহত হয় অন্তত ৭৫ জন।
এদিন রাজধানীতে মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। গ্রেপ্তার হন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
২০ জুলাই
কারফিউ ভেঙে এদিন ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতা রাজপথে নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ওপর চড়াও হয়। সংঘাতে নিহত হয় কমপক্ষে ৩৩ জন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে দেখা করে আটটি দাবি জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। এই সাক্ষাৎ নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।
কারফিউ বহাল থাকায় ২১ ও ২২ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
২১ জুলাই
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আপিল বিভাগে শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়।
৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের কোটা রেখে বাকি ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের আদেশ দেয় আদালত। সরকার চাইলে কোটার হার পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে বলেও আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়।
কারফিউর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়।
২২ জুলাই
বিচ্ছিন্ন সংঘাত ঘটলেও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। সংঘাত শুরুর পর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় পুলিশ।
কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। চার দফা দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে আলটিমেটাম দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সাধারণ ছুটির মেয়াদ ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার।
২৩ জুলাই
আপিল বিভাগের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে সব গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে।
কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে।
রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত আকারে চালু করা হয়। সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে ২৪ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়।
২৪ জুলাই
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মামলার হয়রানিতে ফেলা হবে না বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তবে চলমান আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা সরে আসছে না বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
২৫ জুলাই
মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন পরিদর্শন শেষে সারাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় দেশবাসীর কাছে বিচার চান শেখ হাসিনা।
দেশ ধ্বংসের দলীয় এজেন্ডা আড়াল করতে বিএনপি-জামায়াত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।
সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।
২৬ জুলাই
সংঘাত-সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির বিচার দাবি করে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। কারফিউ শিথিলের মধ্যে ঢাকায় গানের মিছিল হয়।
ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
২৭ জুলাই
বাংলাদেশকে আবার ‘ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতেই’ কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সারাদেশে সহিংসতা ও হত্যার প্রতিবাদে ২৮ জুলাই গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
২৮ জুলাই
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘জামায়াত-শিবির ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ’ করেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় সারাদেশে কয়েকদিনে ১৪৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
যদিও বাইরে থাকা সমন্বয়করা এই ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘জোর করে’ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয় অভিযোগ করে নতুন কর্মসূচি দেন তারা।
২৯ জুলাই
গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধসহ আটক শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশ।
৩০ জুলাই
কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সারাদেশে শোক পালন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার লাল করে চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা গানের মিছিল বের করে।
৩১ জুলাই
সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শতাধিক মানুষ হত্যার ঘটনার বিচার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতা ।
শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষ হত্যার দায় নিয়ে সরকারের প্রতি পদত্যাগের আহ্বান জানান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।
১ আগস্ট
ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুম।
সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে পালিত হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি।
‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২ আগস্ট
ঢাকায় প্রেসক্লাবে আয়োজিত দ্রোহযাত্রায় সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানান।
ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক বলেন, ডিবি কার্যালয়ে হেফাজতে থাকাকালে স্বেচ্ছায় তারা আন্দোলন প্রত্যাহারের বার্তা দেননি। জোর করে তাদের দিয়ে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছিল।
৯ দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৩ আগস্ট
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা।
তবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ১ দফা দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।
৪ আগস্ট
দেশব্যাপী সহিংসতায় শিক্ষার্থী, পুলিশ সদস্যসহ প্রায় একশজন নিহত হওয়ার খবর আসে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়াসহ অবসরপ্রাপ্ত এক দল সেনা কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীকে ছাউনীতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায় তারা।
পূর্বঘোষিত ৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রূপান্তরের রূপরেখা প্রস্তাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সরকারের পক্ষ থেকে অনির্দিষ্টকাল কারফিউ জারি। যে কোনও নাশকতা কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ শেখ হাসিনার। শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হতে না দিতে অভিভাবকদের প্রতি সরকারের বার্তা।
৫ আগস্ট
ঢাকায় সকাল থেকে কঠোর অবস্থানে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘর্ষ। দুপুরের আগে সড়ক পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাগের দিকে মিছিল এগোতে থাকে বিনা বাধায়। দুপুরের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরমধ্যে খবর আসে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের রওনা হয়েছেন শেখ হাসিনা। তাদের আগরতলা হয়ে দিল্লি পৌঁছনোর খবর আসে ভারতের সংবাদমাধ্যমে।
ঢাকার রাজপথজুড়ে উল্লাস; গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে জনতা। সরকারি এসব ভবন থেকে যে যা পায়, নিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু স্মতি জাদুঘরসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ। বিভিন্ন পুলিশ থানা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়।
৬ আগস্ট
সরকারহীন, পুলিশহীন দেশে অরাজকতা চলতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে। ডাকাত আতঙ্ক ছড়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাব মেনে নেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়।
সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকটি রদবদল হয়, চাকরিচ্যুত হন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
৭ আগস্ট
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে বাদ দিয়ে মো. ময়নুল ইসলামকে আইজিপি নিয়োগ। র্যাব ও ডিএমপি কমিশনারও পরিবর্তন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন পদত্যাগ করেন। মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নিয়োগ বাতিল করা হয়।
সাত বছর পর নয়া পল্টনে দলের সমাবেশে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে হাজির হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন তারেক রহমান।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূসের ৬ মাসের সাজা বাতিল করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। এদিন ফ্রান্স থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন ইউনূস।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান জানান, পরদিন রাত ৮টায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিতে পারে।
৮ আগস্ট
দুপুরে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন ড. ইউনূস। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। সাংবাদিকদের ইউনূস বলেন, “আমার প্রথম কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।”
রাতে বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ ১৪ জন উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বাকি তিন উপদেষ্টা ঢাকায় না থাকায় তারা পরে শপথ নেবেন।
শপথ গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে শুভকামনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।