ভারতে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়াকে ‘অবন্ধুসুলভ আচরণ’ হিসেবে দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ঢাকা যতক্ষণ না প্রত্যর্পণ চাইছে ততক্ষণ দুই দেশের ‘অস্বস্তি’ এড়াতে তার উচিত চুপ থাকা।
ভারতের সংবাদমাধ্যম প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
কোটা সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তিনি ভারতেই রয়েছেন।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পান শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঢাকায় সরকারি বাসভবন যমুনায় পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, “যতদিন বাংলাদেশ তাকে ফেরত না চাইছে ততদিন ভারত তাকে রাখতে চাইলে শর্ত হবে, তাকে চুপ থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “ভারতে তার অবস্থানে কেউই স্বস্তি বোধ করছে না। আমরাও তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে ফেরত আনতে চাই। তিনি ভারতে অবস্থান করছেন আর কথা বলছেন- সেটাই সমস্যা তৈরি করছে। তিনি যদি চুপ থাকতেন, আমরা ভুলে যেতাম। মানুষ তার কথা ভুলে যেত, যদি তিনি তার নিজের জগতে থাকতেন। কিন্তু তিনি ভারতে বসে কথা বলছেন এবং নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ সেটা পছন্দ করছে না।”
৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরে ১৩ আগস্ট ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন শেখ হাসিনা।
বিবৃতিতে তিনি জুলাইয়ের আন্দোলন ঘিরে হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। সেসব ঘটনাকে বিবৃতিতে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘ন্যায়বিচারের’ কথাও বলেন তিনি।
শেখ হাসিনার বলা এসব কথা বাংলাদেশ বা ভারত কারও জন্যই ‘ভালো নয়’ বলে মনে করেন ড. ইউনূস। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ‘অস্বস্তি আছে’ বলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশ সরাসরি নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, “এটা সবাই বুঝতে পারছে। তার যে চুপ থাকা উচিত সেটা অনেক দৃঢ়ভাবে বলেছি। এটা আমাদের প্রতি একটা অবন্ধুসুলভ আচরণ। সেখানে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আর তিনি সেখান থেকে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমন নয় যে তিনি স্বাভাবিকভাবে সেখানে গেছেন। জনগণের অভ্যুত্থান আর গণরোষের মুখে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।”
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ খুব বেশি মূল্য দেয় উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, নয়া দিল্লির উচিত ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দলই ইসলামপন্থী’ আর ‘শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে’ সেই চিন্তা থেকে বের হওয়া। তিনি বলেন, “অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও একটি প্রতিবেশী।”
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হামলা হয়। আক্রমণের শিকার হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। হামলা হয় বিভিন্ন থানায়, সহিংসতার মুখে পড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও।
এ প্রসঙ্গে পিটিআইকে ড. ইউনূস বলেন, সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তার সরকারের পতনের পর ভবিষ্যতে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হবে- সে প্রশ্নে উঠেছে।
এ বিষয়ে ড. ইউনূস পিটিআইকে বলেন, “সম্পর্ক উন্নত করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যা এখন বেশ কম হচ্ছে।
“ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঠিক করতে কিছু চুক্তি যেমন ট্রানজিট বা আদানির বিদ্যুৎ চুক্তিতে আবার নজর দেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “সবাই বলছে এসব জরুরি। আমরা প্রথমে দেখব- কাগজে কী আছে আর বাস্তবে কী ঘটছে। এখনই সব নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। যদি পর্যালোচনা করা দরকার পড়ে তাহলে আমরা প্রশ্ন তুলব।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তিনি দিল্লির উপকণ্ঠে একটি আধা-সামরিক বাহিনীর অতিথি নিবাস বা ‘সেফ হাউজে’ রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। তবে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে তাদের অবস্থানের বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর ভারতেই নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এবার শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে ভারতে আশ্রয় নিলেও তার গন্তব্য ইউরোপের কোনও দেশ বলে তখন শোনা গিয়েছিল। তবে পরে তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানান, তার মা অন্য কোনও দেশে আশ্রয়ের আবেদন করেননি।
এরই মধ্যে বিচারের মুখোমুখি করতে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছেন অনেকে। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্টও ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। কূটনৈতিক পাসপোর্ট থাকলে ভিসা ছাড়াই অন্য দেশে ৪৫ দিন অবস্থান করা যায়।
সেই পাসপোর্ট বাতিল হওয়ায় শেখ হাসিনা ভারতে এখন কোন স্ট্যাটাসে রয়েছেন, তা জানা যায়নি। তিনি কোনও বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন, না কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও ভারত সরকার পুরোপুরি নীরব।