সরকার পতনের আড়াই মাস পর সমন্বয়ক কমিটিকে আহ্বায়ক কমিটিতে রূপ দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তাতে আহ্বায়ক করা হয়েছে হাসনাত আব্দুল্লাহকে। চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য সচিব আরিফ সোহেলকে। কমিটিতে আবদুল হান্নান মাসউদকে মুখ্য সংগঠক এবং উমামা ফাতেমাকে মুখপাত্র করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন থেকে আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে জানানো হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কখনও রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হবে না।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসের শুরুতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামার পর তা এগিয়ে নিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়। সেখানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সমন্বয়কের দায়িত্ব নেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে গত ৩ আগস্ট সমন্বয়ক কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
সেই আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তারপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, তাতে উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন কেন্দ্রীয় দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
তার আড়াই মাস পর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ এবং আন্দোলনরতদের ওপর নিপীড়নকারী ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
রাত ৮টার দিকে সেখানে সংবাদ সম্মেলনে আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম।
সব সমন্বয়কের মতামতের ভিত্তিতে এই কমিটি করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “সারাদেশে ভুয়া সমন্বয়কের নামে অনেক অপকর্ম হচ্ছে। মূলত এটাকে রোধ করতে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করছি। যারা আমাদের মধ্য থেকেও এ ধরনের অপকর্ম করে, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেই আমাদের কমিটিতে পুনর্গঠন প্রয়োজন।”
শিগগিরই এই কমিটি বর্ধিত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সারজিস বলেন, “আগামীতেও এই সংগঠনের অনেক কাজ করতে হবে। এজন্য সংগঠনকে সারাদেশের জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
“ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। এজন্য আরও সুসংগঠিত হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্টদের প্রতিহত করতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে নতুন আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান ও মুখপাত্র উমামা ফাতেমাসহ কয়েকজন সমন্বয়ক বক্তব্য দেন।
সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি জাতীয় সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। এটি কখনও রাজনৈতিক দলে রূপ নেবে না।”
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ায় সমন্বয়ক সারজিস আলমকে সংবাদ সম্মেলনে অভিনন্দনও জানান অন্য সমন্বয়কেরা।
এর আগে সমাবেশে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “চুপ্পু (রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন) মসনদে বসে ফ্যাসিবাদের চর্চা করে যাচ্ছেন। তার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমাদের বিপ্লব শেষ হয় নাই।
“আমরা হাসিনাকে হটিয়েছি, কিন্তু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে পারি নাই। যতদিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারছি, ততদিন এই আন্দোলন চলবে।”
তিনি ডানপন্থী এবং বামপন্থী সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে এক হওয়ার আহ্বান জানান।
সমাবেশ থেকে হাসনাত আব্দুল্লাহ পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেন-
১. অনতিবিলম্বে ৭২ এর সংবিধান বাতিল করতে হবে। সে জায়গায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ থেকে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে।
২. এই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তাদেরকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. এই সপ্তাহের মধ্যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীনকে পদচ্যুত করতে হবে।
৪. জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের আলোকে ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
৫. ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। একই সাথে তারা যেন ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে না পারে ও নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাসনাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে থাকা হান্নান ও উমামাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সদস্য সচিব আরিফ সোহেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
গত ৩ আগস্ট সমন্বয়ক টিম পুনর্গঠনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোট সমন্বয়ক ছিল ৪৯ জন, সহ সমন্বয়ক ছিল ১০৯ জন। সব মিলিয়ে টিমে মোট সদস্য ছিল ১৫৮ জন।
এই ১৫৮ জনের বেশিরভাগই ঢাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজের তিন শিক্ষার্থী সমন্বয়ক ছিল।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকািরি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমন্বয়ক ছিল।
সহ সমন্বয়কদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিল। তবে এই ১০৯ জনের বেশিরভাগই ছিল ঢাকার।
আন্দোলনের সূচনায় গত ৯ জুন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ব্যানার বদলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ হওয়ার পর
আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র হয়ে সামনে আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নাহিদ। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটি সংগঠনের সদস্য সচিব ছিলেন।
২০১৮ সালে যে আন্দোলনে চাকরিতে নিয়োগে কোটা বাতিল করেছিল সরকার, সেই আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরের সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে এই সংঠনটি গড়ে তোলে। ৫ আগস্টের পর সংগঠনটি বিলুপ্ত করা হয়।
নাহিদের পাশাপাশি আসিফ মাহমুদও ছাত্র শক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন।
আন্দোলনের শুরুতে নাহিদের মাধ্যমে কর্মসূচি এলেও পরে সমন্বয়ক টিমে সদস্য বাড়ানো হয়। প্রথমে সমন্বয়ক টিমে ৬৫ জন সদস্য থাকার কথা জানানো হয়েছিল। পরে ১৫৮ জন করা হয়। এখন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলো।