কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে তাদের সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা হারুন-অর রশীদের খাওয়া-দাওয়ার ছবি-ভিডিও প্রচার দেখে উষ্মা প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা একটি রিট আবেদনের শুনানির এক পর্যায়ে সোমবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আসে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী যখন বলেন ‘ছয়জনকে দেখেছি ডিবি অফিসে কাঁটা চামচ দিয়ে খাচ্ছে’, তখন আদালতে উপস্থিত অন্য আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
তখন বেঞ্চের এক বিচারক বলেন, “জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন। ছবি তুলে আবার সেটি প্রচার করেন।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অবরোধে সংঘাত সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর এই প্ল্যাটফর্মের ছয়জন সমন্বয়ককে শনি ও রবিবার তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে গত শুক্রবার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরে সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও ধরে নেওয়া হয় মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে।
এরমধ্যে রবিবার রাতে ডিএমপি-ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের এক ফেইসবুক পোস্টে তার সঙ্গে বসে ছয়জন সমন্বয়কের খাওয়ার কিছু ছবি দেওয়া হয়।
তার ক্যাপশনে লেখা হয়- “কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ওদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সাথে কথা বললাম। কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে!
“ওদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি ডিএমপি বদ্ধপরিকর।”
এরপর আন্দোলনের সমন্বয়কদের একটি ভিডিও পাঠানো হয় সংবাদমাধ্যমে, সেখানে নাহিদকে আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলতে শোনা যায়।
হাইকোর্টের উষ্মা প্রকাশের পর পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। তিনি বলেছেন, হাইকোর্ট কী বলেছে, তা না শুনে তিনি কোনও মন্তব্য করতে পারছেন না।
তবে সোমবার দুপুরে ছয় সমন্বয়কের পরিবারের সঙ্গে ডিবি অফিসে হারুনের খাওয়ার আরেকটি ভিডিও এর মধ্যে এসেছে।
যে রিট আবেদনের শুনানিতে হারুনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উচ্চ আদালতের মন্তব্য আসে, সেই আবেদনটি করেন আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা ও মানজুর আল মতিন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অনীক আর হক, আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
আবেদনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
শুনানির শুরুতেই রিট আবেদনকারী আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, “আন্দোলনকারীদের ওপর অবাধে গুলি ছোড়া হচ্ছে। বিবিসি, আল জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ আছে। আমাদের সেনাবাহিনী মাত্র ২০ গজ দূরত্ব থেকে ব্রাশফায়ার করেছে।
“স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ১৪৭ জনের মুত্যৃ হয়েছে। সরকারি বাহিনীগুলো ছিল সশস্ত্র। বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র। গত কয়েক দিনের ভিডিও ফুটেজ আমরা দিতে পারব।”
আদালত তখন বলে, “বিবিসি বাংলাসহ অনেক বিদেশি মিডিয়ায় নিউজ বিকৃত করে প্রচার করেছে। সুতরাং ওইসব নিউজ আসলে অকাট্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।”
তখন মানজুর মতিন বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই ১৪৭ জনের মৃত্যুর কথা বলেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম দুই শতাধিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। সেসবের ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিও ফুটেজগুলো কিভাবে অস্বীকার করবেন?”
আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন শিশুর মৃত্যুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি শিশু ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।
বিচারক তখন বলেন, “এর দায় কার?”
মানজুর বলেন, “নিঃসন্দেহে এটা সরকারের দায়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার কোনও সুযোগ নাই। ৬ জন সমন্বয়কারীকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। ডিবি বলছে, তাদের নিরাপত্তার জন্যেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানো হলো কীভাবে? এখানে সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কেউ পাঞ্জাব থেকে আসেনি।”
হাইকোর্ট তখন বলে, এখানে অনেক রাজনৈতিক বিষয় জড়িত আছে। সুতরাং কোর্ট যাতে বিতর্কিত না হয়।
এরপর আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, “আমাদের আরজি হলো তাজা গুলি ছোড়া বন্ধ করা, তাতে প্রাণরক্ষা হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, সেটাও আমরা চাই না। কিন্তু যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশেই বয়সে তরুণ। তারাও দেশের সম্পদ। অবশ্যই যাতে তাজা গুলি বন্ধ করা উচিৎ। আমরা আর একটিও প্রাণহানি চাই না।”
সারা হোসেন ছয় সমন্বয়ককে তুলে নেওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, “গোয়েন্দা শাখা বলছে, তাদের গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি। তাদের হেফাজতে আছে। কিন্তু সংবিধানে এমন কোনও সুযোগ নাই। এমনকি কোনও আইনেও নাই। এভাবে আটক রাখার ক্ষমতা তারা কোথায় পেল? নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে তুলে নেওয়া যায়, এটা কোথায় আছে? গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে তুলে নেওয়ার কথা কোথায় আছে? আমরা কখনও এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। এই ছয়জনের রিলিজ করাতে চাই।”
জেড আই খান পান্না বলেন, “আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।”
আদালত তখন বলে, “কোটার সমস্যা তো আপিল বিভাগে সমাধান হয়েছে।”
পান্না বলেন, “সমস্যার তো সমাধান হয়নি। একাত্তর সালে দরজায় নক করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজা হতো। এখন রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে- ছাত্র আছে কি না? তাদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে চেক করা হচ্ছে। এটা কি আইন সঙ্গত?”
রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান এরপর বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে আইনের প্রয়োগ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। যারা রিট আবেদন নিয়ে এসেছে তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পরবেন যে বিটিভি, সেতু ভবন, মেট্রোরেলে হামলা হবে না? নরসিংদীর জেলে হামলা হয়েছে। সেখানের বন্দিরা পালিয়েছে। এটা কিসের ইঙ্গিত?”
তখন আদালত বলে, “এ ঘটনার আগে মিছিলে একটি ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে। তারপর এই ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একটা মব গিয়ে সেখানে হামলা হয়েছে।”
মেহেদী হাছান তখন বলেন, “দেশে যদি মব হয় সেখানে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে পারবে না? যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে তাহলে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে।”
এই রিট আবেদনের অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে মন্তব্য করে তিনি ডিবি কার্যালয়ে ছয়জন সমন্বয়কের কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার বিষয়টি বললে তখন আদালত উষ্মা প্রকাশ করে।
এরপর মেহেদী হাছান বলেন, “ওই ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা তো আসেনি।”
অনীক আর হক রিট আবেদনে আদালতের মৌখিক আদেশ চাইলে বিচারক বলেন, “মৌখিক আদেশে তো কোনো কাজ হবে না।”
এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, “দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ উপায়ে বল প্রয়োগ করেছে- এই বিষয়টি আবেদনে কোথাও বলা নেই। তারা ভিত্তিহীন ধারণার ওপর আবেদনটি নিয়ে এসেছে।”
আদালত তখন বলে, যদি ওই ৬ ছাত্রকে আটক না করে থাকেন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করুন।
মোরশেদ তখন বলেন, “তাদের পরিবার কী বলছে, সেটি দেখতে হবে। ডিবি বলেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০০ লোক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে, এটার প্রমাণ কী?”
তখন আদালতে উপস্থিত আইনজীবী আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা দেশে শান্তি চাই। সহিংস পরিস্থিতি চাই না। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন নেই। তারপরও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং সার্বিক বিবেচনা করে একটি আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।”
এরপর আদালত আদেশের জন্য মঙ্গলবার দিন ঠিক করে দেয়।
এই রিট আবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।