ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) নিচতলায় ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-১ এ বেশ কয়েকটি বেড লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। এই ফিতা দেওয়া বেডগুলোতে শুয়ে আছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার ও পরে সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় আহতরা। অনেক রোগীর ভিড়ে সহজেই যাতে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়, এজন্যই এই ব্যবস্থা।
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে কারও শিরাপথে স্যালাইন চলছে, তো কাউকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। কারও পুরো হাত বা পা ব্যান্ডেজে বাঁধা। কেউ মাত্র অস্ত্রোপচার শেষে বেডে এসেছে। ব্যথায় কুঁকড়ে আছে চেহারা। চোখ দিয়ে গড়াচ্ছে পানি।
এক বেডে শুয়ে আছেন গুলিবিদ্ধ আরিফুল ইসলাম। ডান পায়ে ব্যান্ডেজ। হাসপাতালে ভর্তির পর একবার অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। মঙ্গলবার আরও একবার হবে। তবে দুবার অস্ত্রোপচার শেষে আরিফুলের পা পুরোপুরি ভালো হবে কি না, তা চিকিৎসকরা এখনই বলতে পারছেন না।
তিন মাসের আরাফকে নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন আরিফুলের স্ত্রী মারুফা বেগম। জানালেন, দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে তাদের। মিরপুর-১০ নম্বরে মসজিদের সামনে আতর, টুপি, তসবি বিক্রি করেন আরিফুল।
৪ আগস্ট বিকালে মসজিদে নামাজ আদায় শেষে আরিফুল দেখতে পান, ৯/১০ বছরের একটি শিশুর বুকে গুলি লেগেছে। শিশুটিকে বাঁচাতে কাছেই আজমল হাসপাতালে নিতে চান তিনি। সেসময় পুলিশ আরিফুলের পায়ে গুলি করে। গুলি লাগার পরও আরিফুল শিশুটিকে ছাড়েননি। পুলিশ তখন তার পায়ে আবার গুলি করে।
পরপর দুবার গুলির কারণে আরিফুলের পায়ের হাড় ভেঙে গেছে আর রগ ছিড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা মারুফাকে জানিয়েছেন।
মারুফা বলেন, আরিফুল যেদিন গুলিবিদ্ধ হন, সেদিন তার কোনও খোঁজ পাননি তিনি। পরদিন এক স্বজনের মাধ্যমে জানতে পারেন, তার স্বামী পঙ্গু হাসপাতালে আছেন।
আরিফুলের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন মারুফা। বলেন, “আমার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠুক-এডাই কেবল চাওয়া। উনি যদি বিছানায় পরে থাকেন, তাইলে সংসারের হাল ধরব কে? বাচ্চাডা বড় হবে ক্যামনে? ওর ভবিষ্যৎ কী হবে?”
মিরপুরের আরিফুলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সোহেল মিয়াকেও গুলি করে পুলিশ।
তার বড় ভাই রুবেল মিয়া জানান, সেদিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার ছোট ভাই। খুব কাছ থেকে পুলিশ তাকে গুলি করে। গুলি সোহেলের পায়ে ঢুকে বের হয়ে যায়। একবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও করা হবে। সোহেলের পরিবারও জানে না, তিনি আদৌ আগের মতো হাঁটতে পারবেন কি না।
রুবেল জানান, একটা কারখানায় কাজ করতেন সোহেল। আন্দোলনের সময় চাকরি চলে যায় তার। তার স্ত্রী গর্ভবতী। সবমিলে চোখে অন্ধকার দেখছেন সোহেল।
তার পাশের বেডে আছেন শাকিল আলমগীর। তিনিও একই দিন উত্তরার আজমপুরে আহত হন।
শাকিল বলেন, “সেদিন একদিকে ছিলাম আমরা। আরেকদিকে পুলিশ আর ছাত্রলীগ। পুলিশের হাতে বন্দুক আর ছাত্রলীগের হাতে রামদা। সেখান থেকেই একজন আমার দিকে রামদা ছুড়ে মারে। এতে আমার বাম পায়ের নিচের সব রগ ছিড়ে যায়।
“প্রথমে আমাকে কুয়েত (কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা অপারগতা জানালে এখানে আনা হয়।”
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-১ এর চিত্র মোটামুটি এমনই। তবে ওয়ার্ড-২ এর চিত্র ভিন্ন। সেখানে ঢুকেই থমকে যেতে হয় কারণ পুরো ওয়ার্ডজুড়ে সব বেডে লাল ফিতা লাগানো।
এই ওয়ার্ডের সবাই আন্দোলনে আহত কি না-জানতে চাওয়া হলে সেখানকার জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স জাহিদুল ইসলাম বলেন, “এরা সবাই আন্দোলনে গুলি খাওয়া রোগী।”
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- এই দুই ওয়ার্ডেই শুধু আন্দোলনে আহতরা আছেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, “তারা গোটা হাসপাতালেই আছেন। তবে দুই নম্বর ওয়ার্ডের সব রোগীই আন্দোলনের সময় আহত হয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে রোগীসংখ্যা কম কারণ সেখানে বেড রাখার মতো জায়গা আর নেই।”
পা কেটে ফেলতে হয়েছে এমন রোগী দুই নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমানে আছেন চারজন। তাদের মধ্যে তিনজন তাদের বেডেই আছেন। বাকিজনকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গুলিবিদ্ধ ওই তিনজনের একজন রাকিব হোসেন। ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ি এলাকার চিটাগাং রোডে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
রাকিব বলেন, “পুলিশ আর সেনাবাহিনী সেদিন সন্ধ্যায় মিছিলে আন্দাগুন্দি গুলি করছে। চোখের সামনে কত মানুষ মরে পড়ে গেল।”
গুলিবিদ্ধ রাকিবকে তার স্বজনরা প্রথমে স্থানীয় এক হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আহতদের ভিড় বেশি থাকায় স্বজনরা তাকে হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাকিবকে পঙ্গু হাসপাতালে আনার পরপরই চিকিৎসকরা জানান, তার পা রাখা যাবে না। কেটে ফেলতে হবে।
দুদিন পর ২২ জুলাই রাকিবের পা কেটে ফেলা হয়। তার নানা শাহজাহান চৌধুরী তার মাথার পাশে বসেছিলেন। আদরের নাতির গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে কুমিল্লা থেকে এসেছেন তিনি।
শাহজাহান চৌধুরী বলেন, “আমার চার মাইয়া। তয় মাইয়াদের সব সন্তানের মধ্যে এই নাতিই আমার বেশি প্রিয়। ওয় গুলি খাইছে। আমার কি আর প্রাণডা আছে? আইয়া পড়ছি। কিন্তু এই পোলাডার একটা পা তো কাইট্যাই ফেললো। পুরা জীবনডা এই পোলার ক্যামনে কাটবে? কে খাওয়াবে ওরে? ওর ভবিষ্যৎ কী হইব?”
রাকিবের এখন পর্যন্ত তিনবার অপারেশন হয়েছে বলে জানান তার নানা শাহজাহান চৌধুরী।
পঙ্গু হাসপাতালে রাকিবের মতোই পা হারিয়ে শুয়ে আছে নাদিম হোসেন। যাত্রাবাড়িতে এক অ্যাম্ব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করত এই কিশোর। ২০ জুলাই সন্ধ্যার দিকে কারখানা থেকে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয় সে।
নাদিমের বাবা দুলাল হোসেন রিকশা চালান। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি খবর পান, তার ছেলের গুলি লেগেছে; পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে যাওয়ার পর দেখেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার ছেলেকে ভর্তি করাতে চাইছে না।
এরপর নাদিমকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাকে ব্যান্ডেজ আর স্যালাইন দিয়ে বিদায় করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এরপর নাদিমকে নেওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার কক্ষেও নেওয়া হয় নাদিমকে।
কিন্তু সেখান থেকে চিকিৎসকরা বলেন, এই রোগী এখানে রাখা যাবে না।
নাদিমের বাবা দুলাল হোসেন বলেন, “ওই হাসপাতালের ডাক্তাররা জানায়, তার পা কাইটা ফেলতে হইব। তারা তাকে অন্য কোনও হাসপাতালে দ্রুত নিয়া যাইতে বলেন। এরপর নাদিমরে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়া যাই।”
ছেলেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে কেন নিলেন-জানতে চাইলে দুলাল হোসেন বলেন, “ওইটা তো বড় হাসপাতাল। যদি তারা পা-টা রাখতে পারে। জমি-জিরাত সব বেইচা দিয়া হলেও ছেলের পা-টা রাখতে চাইছিলাম।”
কিন্তু ল্যাবএইড হাসপাতালেও ছেলেকে রাখতে পারেননি দুলাল হোসেন।
তিনি জানান, ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসকরা নাদিমকে স্যালাইন আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যান্ডেজ পাল্টে নতুন ব্যান্ডেজ লাগান। এরপর তারা তাকে জানান, সেখানে নাদিমের চিকিৎসায় কয়েক লাখ টাকা খরচ হবে। যেহেতু তিনি স্বচ্ছল নন, তাই ছেলেকে তার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
এরপর ২১ জুলাই রাতে নাদিমকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
ঘুমন্ত ছেলের পাশে বসে দুলাল হোসেন বলেন, “ছেলেডা আমার ১০ হাজার টাকা বেতন পাইত। আমার আর তার ইনকাম দিয়াই সংসার চলত। এখন সারাদিন সে কান্নাকাটি করে। লোকজনরে হাঁটতে দেখলে চিৎকার কইরা কান্দে। সব শেষ হয়ে গেল। পা গেল ছেলেডার। সঙ্গে গেল পরিবারডাও।”