কৃষকরা এক রকম ‘গোলকধাঁধা’র মধ্যে রয়েছেন, বললেন ময়মনসিংহের কৃষি উদ্যোক্তা ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। এই গোলকধাঁধার কারণ চলমান তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহ এই গ্রীষ্মে কমবে, তেমন আভাস এই মুহূর্তে নেই।
বৈশাখের শুরু থেকেই তাপপ্রবাহে নাকাল জনজীবন। থার্মোমিটারের পারদ চড়ছে প্রতিদিনই। দেশে বুধবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি।
দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে তাপপ্রবাহ চলছে জানিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক আজিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, এটা অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, আগামী পাঁচ দিন তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। মাঝে মাঝে কালবৈশাখী ঝড় হলেও তাতে সাময়িক স্বস্তি মিললেও তাপমাত্রা কমবে, তেমন আভাস নেই।
দেশের ৫৪ জেলাজুড়ে তাপদাহে ক্ষতির মুখে কৃষি উৎপাদন। উৎপাদন কমার আশঙ্কা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদনে গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপপ্রবাহ প্রলম্বিত হলে কৃষিতে বিশেষ করে চলতি মৌসুমের ধানসহ অন্যান্য ফল-ফসলের সামগ্রিক উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে অন্তত ৩০ শতাংশ।
তাপপ্রবাহ কোথায় কোথায়
এখন রাজশাহী, পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাটের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্য অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসাবে চিহ্নিত করে আবহাওয়াবিদরা। ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।
রাঙামাটিতে গত ১০ এপ্রিল তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। একই দিনে ২১টি জেলায় তাপমাত্রা ছাড়ায় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর. রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী,পিরোজপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কৃমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, রংপুর, ও লালমনিরহাট জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
তাপে পোড়ার শঙ্কা, সেচে বাড়তি খরচ
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছে, এই তাপদাহে ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে অন্য বারের তুলনায় তিন গুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচও বাড়বে সেই হিসাবে।
ময়মনসিংহের কৃষি উদ্যোক্তা আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তাপপ্রবাহ অনেক সময় কৃষকদের ভালো ফলন এনে দেয়। তবে এই মূহূর্তের তাপপ্রবাহ কৃষকদের জন্য ‘কান্নার কারণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কান্নার কারণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “ধান চাষের সময় সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর যদি ওঠে, তাহলে চিটার পরিমাণ বেশি হতে পারে। এই মুহূর্তে অনেকের মাঠের ধানে থোড় এসে পড়েছে, এখন ক্ষেতের মধ্যে কমপক্ষে দুই ইঞ্চির পানির ধারা থাকতেই হবে।
“কিন্তু তাপপ্রবাহের কারণে চাইলেও সেই পানির প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে ধানের ফুল পলিনেশন করতে পারছে না, অনেক ফুল ঝরে যাচ্ছে। একারণে ধরে নেওয়া যায়, ধান চাষে গড়ে ৩০ শতাংশের মতো ক্ষতির মুখে পড়তে পারে কৃষক।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম শাহজাহান মণ্ডল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তাপমাত্রা বেশি থাকলে সেচের পানি বেশি লাগে, সেজন্য কৃষকের খরচ বেড়ে যায়। আবার অতিরিক্ত গরমে সেচ পাম্প অকেজো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সেচের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি উদ্যোক্তা প্রিন্স বলেন, “বিদ্যুৎ কম-বেশি আমরা পাচ্ছি আমাদের এলাকায়, তবে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ভোল্টেজ সমস্যা করছে। ভোল্টেজ কম থাকার কারণে পানির প্রবাহ সেভাবে মিলছে না।
“স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ কম পানি উঠছে পাম্পগুলোতে। আবার দীর্ঘক্ষণ চালানোর কারণে বিল ঠিকই বাড়ছে, কিন্তু ওই পরিমাণ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার পানি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে যাচ্ছে, গাছ শোষণ করতে পারছে না। সব মিলিয়ে কৃষকদের একটা বাজে অবস্থা।”
অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, এখন আউশ মৌসুম চলছে। আবার কৃষক পাট বুনেছে। এরকম গরম কয়েকদিন থাকলে বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার কালবৈশাখীতেও ফসলের ক্ষতি হয়।
তাপদাহের কারণে আম, লটকন, মাল্টা, অ্যাভাকাডার মতো গাছের গুটি ঝরে যাচ্ছে বলেও জানান প্রিন্স।
“যে অবস্থা, তাতে বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে,” শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ভূগর্ভস্থ পানি বেশি তোলার বিরূপ প্রভাবের কথাও তুলে ধরেন অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল। তিনি বলেন, “এর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে হ্যান্ডটিউবওয়েলে পানি মিলছে না সেভাবে।”
এরকম তাপমাত্রা বছরব্যাপী স্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা করছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টেন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্লানেটরি বিভাগের ‘ফুলটাইম একাডেমিক’ আশরাফ দেওয়ান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বাড়ছে। সুতরাং আমাদের ক্রপ ক্যালেন্ডার বজায় রেখে উৎপাদন বাড়ানো কঠিন হবে। এজন্য জলবায়ুসহিষ্ণু ফসল উৎপাদনের বিষয়ে জোর দিতে হবে। জলবায়ু সংবেদনশীল কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে যাতে আধুনিক কৃষি উৎপাদনের বিকাশ করা সম্ভব হয়।”
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর আগুপিছু ফসলের ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা তুলে ধরেন অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডলও।
তিনি বলেন, শীতকালের পরিসর কমে গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হলেও চাইলেই ফসল চাষের সময় এগিয়ে আনা সম্ভব হয় না । এজন্য তাপমাত্রার উর্ধ্বমুখী অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এজন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।