দাবদাহের কারণে রোজা-ঈদের ছুটি এক সপ্তাহ বাড়ানোর পর খুলেছে স্কুল ও কলেজ। তবে শুরুর দিনই গরমের কারণে সরকারের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ ঝরেছে অভিভাবকদের কণ্ঠে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় আবার একদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল বন্ধ রাখা সমাধান নয়, বরং স্কুলে শিশুদের সুরক্ষা দিয়ে খোলা রাখার বন্দোবস্ত করতে হবে।
এবার রোজা-ঈদের ছুটি শেষে স্কুল-কলেজ খোলার কথা ছিল গত ২১ এপ্রিল। কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকে টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে কয়েক জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। সে কারণে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজে ছুটি বাড়ানো হয়।
তবে রবিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিনেই চলমান ‘হিট অ্যালার্টের মেয়াদ আরও তিন দিনের জন্য বাড়ায় আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও আগামী কয়েকদিনে তাপপ্রবাহ প্রশমন কিংবা বৃষ্টির কোনও আভাস নেই।
তারমধ্যেই রবিবার স্কুল খোলার পর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানে গরমের মধ্যেই ক্লাস করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবে অভিভাবকরা ছিলেন বেশ উচ্চ কণ্ঠ।
হয় বন্ধ না হয় অনলাইন ক্লাস
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে রাস্তায় বসে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সালমা আহমেদ। মগবাজারে তার বাসা। সকালে সন্তানকে স্কুলে নিয়ে এসেছেন বাসে করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি নিজে প্রেসারের রোগী। এই গরমে আমিই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ঘামে পুরো ভিজে গেছি। এর মধ্যে সম্ভব বাচ্চাদের নিয়ে বের হওয়া? ওকে নিয়ে আবার বাসায় যেতে হবে বাসে, তখন না জানি কী হয়?”
তীব্র গরমে নারিন্দা থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে নিতে এসেছিলেন সিরাজুল আলম। মেয়ে স্কুল থেকে বের হলে রিকশা খুঁজছিলেন তিনি।
তখন সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এত গরম, তার ওপর চারিদিকে রাস্তা কাটা। এই পরিস্থিতিতে স্কুল খোলা রাখা উচিৎ হবে না। আমার মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শরীর খুব খারাপ লাগছে।”
একই ধরনের মন্তব্য বেশিরভাগ অভিভাবকদের। শিক্ষার্থীরাও বলছে দুর্ভোগের কথা। ওই স্কুলেই চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, “ক্লাসে কষ্ট কম হয়েছে। সকালে আসতে আর এখন বাসায় যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। রোদে শরীর খারাপ লাগছে।”
অভিভাবকদের চাওয়া, তাপপ্রবাহ যতদিন চলবে ততদিন যেন স্কুল বন্ধই রাখা হয়। নইলে অনলাইনে ক্লাস চালানো যেতে পারে, যেমনটা কোভিড মহামারির সময় হয়েছিল।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সন্তানের ছুটির জন্য অপেক্ষমান জাকিয়া আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একটু বসার জায়গা নেই। এই গরমে একটাই গাছ এখানে। বাচ্চাদের কেন স্কুলে আসতে হবে? অনলাইনেই তো ক্লাস হতে পারে।”
তার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন আরেক অভিভাবক। কিছুক্ষণ কথোপকথন শুনে তিনি বলেন, “আগে তো সন্তান। সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে পড়াশোনা দিয়ে কী করব?”
কোথাও নেই বিদ্যুৎ, কোথাও নেই পাখা
গরমের তীব্রতার এই সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। আইপিএস বা জেনারেটর সুবিধা না থাকায় গরমে কাহিল হয়ে পড়ছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা।
ঢাকার নামি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, “প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এমনিতেই অনেক গরম। বিদ্যুৎ না থাকলে ক্লাসে মনোযোগই দেওয়া যাচ্ছে না। তখন খুব খারাপ অবস্থা হচ্ছে।”
শহরে বেশ কিছু বিদ্যালয়ে ওপরে টিনের ছাদ। সেসব শ্রেণিকক্ষে যেন আগুনের আঁচ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
এরই মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে তীব্র গরমে রবিবার সকাল ১০টা থেকেই হাতিয়া জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাই স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ বোধ করার খবর পাওয়া যায়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত শিক্ষকসহ মোট ১০ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিদ্যালয়ে চিকিৎসক এনে চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে সেখানে।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর অভিভাবক জাকিয়া আহমেদ বলেন, “আমার মেয়ে অনেকবার বলেছে তার ক্লাসরুমে কয়েকটা ফ্যান কাজ করে না। আজও শুনলাম এগুলো ঠিক হয়নি। এই গরমে ফ্যান না থাকলে ক্লাস কীভাবে করবে?”
গরমের কারণে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে রবিবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নেমে এসেছিল ৬০ শতাংশে। স্বাভাবিক সময়ে উপস্থিতির হার ৮০ শতাংশের মতো থাকে।
সেখানকার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোকসেদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মাত্র তো খুলল। সামনে গরম কমলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়বে।”
দাবদাহে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত তার কাছে তুলে ধরলে তিনি বলেন, “গরমে সবার কষ্ট হচ্ছে সত্যি। কিন্তু আমরা তো সরকারি নির্দেশনায় বাইরে যেতে পারি না। স্কুল খোলার আজকে প্রথম দিন, পরিস্থিতি বুঝে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।”
প্রাথমিকে খোলা, আবার মাধ্যমিকে বন্ধ
আগুন ঝরানো গরমে স্কুলে ছুটি দেওয়ার দাবি অভিভাবকরা তুললেও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল রবিবার দুপুরেই বলেছিলেন, তিনি স্কুল খোলা রাখার পক্ষপাতি।
তবে কোনও জেলায় তাপ অসহনীয় পর্যায়ে গেলে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহ উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলার পর রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সোমবার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
ঢাকা ছাড়া অন্য জেলাগুলো হলো চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী। এর মধ্যে ঢাকা বাদে অন্য চারটি জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। যশোরে রবিবার তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, চুয়াডাঙ্গায় ছিল ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি। খুলনা ও রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রির ওপরে। তবে ঢাকায় ছিল ৩৯ ডিগ্রি।
মাধ্যমিকে ছুটি দিলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় সেই পথে এগোয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। এসময় তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয় থাকে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
শিক্ষার্থীর সুরক্ষায় করণীয়
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন মনে করেন, যে গরম পড়েছে তাতে সব বন্ধ রাখা প্রয়োজন, কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা সমস্যার সমাধান না। বরং তার পরামর্শ, নজর রাখতে হবে শিক্ষার্থীর সুরক্ষায়।
এক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ ভূমিকা নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “সবাই উপদেশ দিলে হবে না। স্বাস্থ্য বিশারদরা উপদেশ দিতে পারে, বাকিদের কাজ করতে হবে। কাজ না করে নাগরিকদের খালি ‘এই করতে হবে’ ‘ওই করতে হবে’- বলে চাপিয়ে দিলে চলবে না।
“শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে যেন বিদ্যুৎ না যায়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে বাতাস সরবরাহের জায়গা থাকতে হবে।”
দাবদাহের তীব্রতা হয়তো এখন বেড়েছে, সামনে তা আরও বাড়তে পারে। তাই মুশতাক হোসেনের মতে, “পরিস্থিতি সামলাতে সামগ্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন নিরাপদ পানি এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ সরকার নিশ্চিত করে, এমন সুপারিশও করেন তিনি।
নিরাপদ পানি আর পুষ্টিকর খাবারের কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী আব্বাস মোহাম্মদ খোরশেদও।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তাৎক্ষণিক শক্তি উৎপাদন করতে পারে এ ধরনের খাবার শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা যেতে পারে।”
পুষ্টিকর খাবারের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এসময় শিক্ষার্থীদের জন্য ডিম রাখা যেতে পারে। ডিম শক্তি বাড়াতে খুব কাজে দেয়।
“আর ক্লান্ত হয়ে পড়া শিশুদের তাৎক্ষণিক শক্তি বাড়াতে কলা রাখা যেতে পারে। শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে খুবই কাজে দেয় এ ফল। তাছাড়া বিদ্যালয়গুলোতে আরও বিভিন্ন রকমের ফল রাখা যেতে পারে।”