বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে বিচারাঙ্গনের নেতৃত্ব খোলনলচে বদলে যাওয়ার দুই মাস পর এবার হাইকোর্টের ১২ বিচারককে বিচারিক কার্যক্রম থেকে আপাতত সরিয়ে দেওয়া হলো।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট বিচারকদের’ অপসারণের দাবিতে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ে যায় একদল শিক্ষার্থী।
এরপর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারককে আপাতত বিচারিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধান বিচারপতি।
হাইকোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভরতদের সামনে গিয়েই বিকালে এই সিদ্ধান্ত জানান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধান বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতির বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে আজিজ আহমদ বলেন, “আপনারা জানেন, বিচারপতি পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ সংক্রান্ত কোনও আইন বিদ্যমান নেই।
“আসলে বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনও বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না।”
বেঞ্চ না দেওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আগামী ২০ অক্টোবর কোর্ট খুলবে, তারা সেখানে বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। বাকি বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে আপনাদের সামনে আসবে।”
সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করেছিল। তবে সেই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট, আপিল বিভাগও সেই রায় বহাল রেখেছিল। এরপর ২০১৭ সালে সরকার রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে, তার শুনানি আর শুরু হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ সেই বিষয়েও বিক্ষোভকারীদের বলেন, “রিভিউ বিষয়ে আগামী ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চে শুনানি হবে এবং ওই দিন ১ নম্বর আইটেমে রাখা হয়েছে।”
১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানার পর বিকাল সোয়া ৪টায় সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ছাড়ে আন্দোলনকারীরা, যারা সকাল ১১টা থেকে সেখানে অবস্থান নিয়ে ছিল।
সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ছাড়ার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা আগামী রোববার বিকাল পর্যন্ত দেখব।”
যে ১২ বিচারকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে, তাদের মধ্যে ছয়জন দুপুরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন।
অন্যদিকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে আজিজ আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ‘বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী’ ব্যানার নিয়ে আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে একদল আইনজীবীও। বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদেরও একই দাবিতে আলাদাভাবে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।
বিক্ষোভকারী আইনজীবীরা বলেন, রাষ্ট্রের ভঙ্গুর অবস্থার জন্য দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিরাও দায়ী। তারা তাদের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা করেনি। তাই তারা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে।
এই ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনেই গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
এরপর গত ১০ অগাস্ট এই আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকে হাইকোর্টে জড়ো হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাদের দাবির মুখে সেদিনই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারক।
পরে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগে নতুন ২৩ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়।
এদিকে দুই মাস নীরব থাকার পর মঙ্গলবার পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা বিক্ষোভ করে। তার পরদিনই বৈষম্যবিরোধীরা কর্মসূচি দেয় সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে।
হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার বিচারপতি আতাউর রহমান খান ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের বেঞ্চের একটি ঘটনা েথকে।
দ্বৈত এই বেঞ্চে শুনানির জন্য আট শতাধিক মামলা কার্যতালিকায় ছিল। এদের অধিকাংশই ছিল আগাম জামিনের মামলা।
মঙ্গলবার বিচারকাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির মাধ্যমে কার্যতালিকায় মামলা তোলার অভিযোগ ওঠে। এতে প্রাথমিকভাবে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সেখানে এক বিচারক এক আইনজীবীকে অশালীন ভাষায় গালাগাল দেন বলে অভিযোগ ওঠে। তখন আইনজীবীরা হইচই শুরু করলে বিচারকরা এজলাস থেকে নেমে যান। পরে ব্যারিষ্টার আশরাফ রহমান নামে ওই আইনজীবী প্রধান বিচারপতির কাছে যান। সব শুনে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের বিচারক বদলেও দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
সেই ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক বুধবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের ডাক দেন। হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে আদালত প্রাঙ্গণে ডাকেন।
বেলা ১১টার পর হাইকোর্টের সামনে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয় তারা। শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়। তারাও মিছিল নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আসে।
বিক্ষোভের কারণে সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার রাস্তাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেনাবাহিনীকেও সেখানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।