বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার। সম্পত্তির ক্ষেত্রেও অধিকার একই। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, তারও এক দশক হল।
কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি এই জনগোষ্ঠীর। আর সেটাই বঞ্চনার প্রধান কারণ বলে তাদের কথায় উঠে আসছে।
নয় বছর আগে ২০১৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে হিজড়াদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশের পর আইন মন্ত্রণালয় একাধিকবার জানিয়েছে, ইসলামী শরিয়া আইন এবং সংবিধান অনুসারে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার আইন করতে অনেকদিন ধরে কাজ করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, হিজড়াদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নিয়ে আইনের খসড়া ‘প্রায় চূড়ান্ত’।
তবে হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, একাধিক মন্ত্রণালয় ও দপ্তর নানা অজুহাতে হিজড়াদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার আইনের খসড়া চূড়ান্ত করছে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে আইনের উদ্যোগ।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় অভিযোগ আসছে, পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে আপন ভাইবোন ও স্বজনদের হাতে মারধরের শিকার হচ্ছেন হিজড়ারা।
হিজড়া অধিকার যুব সংঘের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি (ববি হিজড়া) সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সম্পত্তিই তাদের বঞ্চনার মূল কারণ। কেননা আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে হিজড়াদের অধিকারের কথাটি স্পষ্ট বলা নেই।
“সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্পত্তি পাবে। কিন্তু সেখানেও বলা হয়েছে, কেউ যদি ছেলের পোশাক পরে, সে ছেলের অংশীদারত্ব আর যে মেয়ের পোশাক পরবে, তারা মেয়ের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সম্পত্তি পাবে। কিন্তু আমরা তো বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে যাই কিছু বোঝার আগেই।”
এই চিত্র সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শোভা সরকার, যিনি মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এ হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “স্পষ্ট আইন না থাকায় বাবা-মায়ের সম্পত্তি থেকে হিজড়াদের বঞ্চিত করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা গিয়ে ঘটনার শিকার হিজড়ার পরিবার এবং এলাকার মানুষকে নিয়ে বসে সমাধানের চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে ফল আসে খুব কম।”
তৃতীয় লিঙ্গের উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ায় বাধা কোথায়- তার ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী আইনুন নাহার সিদ্দিকা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের দেশের সম্পত্তির বিষয়টি আসলে ধর্মীয় ব্যাপার। ধর্মীয় আইনে ছেলে এবং মেয়ে ভাগ করা আছে। তাতে তো তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা করে বলা নাই। ইসলাম ধর্ম বলেন, হিন্দু ধর্ম বলেন, কোথাও স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গের কথা বলা নাই।”
সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা বলা থাকলেও বিয়ে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনটি সংবিধানকে ছাপিয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বহু বছর ধরে সম্পত্তির ভাগ চেয়ে আন্দোলন করেছেন জানিয়ে শোভা সরকার বলেন, “সরকার অনেক আইন খুব দ্রুততার সাথে তৈরি করে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ঠেলাঠেলিতে আজ পর্যন্ত হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত আইন করতে পারেনি সরকার। সহসা যে আইন হবে, তাও নিশ্চিত করেনি সংশ্লিষ্টরা”
গত বছরের ১৬ মার্চ হাই কোর্ট থেকে একটি রুল আসে হিজড়াদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে। হিজড়া কল্যাণ বোর্ড গঠন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় সরকারের কাছে।
রিট আবেদনকারী আব্দুল জব্বার জলিলের আইনজীবী মোহাম্মদ আব্দুল হালিম কাফিসকাল সন্ধ্যাকে জানান, সেই রুল এখনও শুনানির অপেক্ষায় আছে। তবে তিনি আশা করছেন, শিগগিরই শুনানি হবে।
এই আইনজীবী মনে করেন, সম্পত্তির অধিকার থেকে আইন ও ধর্ম হিজড়াদের বঞ্চিত করেনি। তবে এক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন।
“হিজড়াদের যারা ছেলের স্বভাব, তারা ছেলে হিসেবে এবং যাদের মেয়ে স্বভাব, তারা মেয়ে অনুযায়ী সম্পত্তি পাবে। তবে এজন্য একটি আইনি কাঠামো প্রয়োজন। সেটা নেই বলেই বঞ্চিত হতে হয়।”
এই সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কাজটি এখন কোন অবস্থায় আছে- জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মো. মোকতার হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হিজড়াদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নিয়ে আইনের খসড়া আমরা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি। এখন তা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারপর মন্ত্রিসভা হয়ে তা আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিংয়ের পর পাসের জন্য পাঠানো হবে জাতীয় সংসদে।”
খসড়া চূড়ান্তের আগে হিজড়াসহ বিভিন্ন সমাজের পর্যায়ে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কমিউনিটি পর্যায়ে এ নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা করেছি। যত দ্রুত সম্ভব আইনটি করার চেষ্টা করছি আমরা।”