Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

হিজড়াদের বঞ্চনার গল্পগুলো সম্পত্তিতেই এসে ঠেকে

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার নিশ্চিতের দাবি উঠছে দেশে দেশে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার নিশ্চিতের দাবি উঠছে দেশে দেশে।
[publishpress_authors_box]

হিজড়া পরিচয় নিয়ে থাকতে চান শহীদ হোসেন শ্রাবণ, তবে এজন্য মাশুল গুনতে হচ্ছে তাকে। পরিবারে নির্যাতিত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

রংপুরের শ্রাবণের অভিযোগ, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতেই তার উপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ।

মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভাইরা বলছেন, শ্রাবণের হিজড়া পরিচয় নিয়ে তারা সমাজে অপদস্থ হচ্ছেন।

সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় শ্রাবণের মতো নির্যাতনের শিকার হিজড়া আরও রয়েছেন। পরিবার থেকে তাদের শুনতে হচ্ছে, ও তো হিজড়া, সম্পত্তি দিয়ে কী হবে?

তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের সরকারি স্বীকৃতির এক দশক পেরিয়ে গেলেও তাদের বঞ্চনার অবসান হয়নি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়েই তারা বেশি নির্যাতনের শিকার, আর তা ঘটছে পরিবারের মধ্যেই।

রংপুরে শ্রাবণ ঘরছাড়া

গত ২৫ জানুয়ারি মারধরের স্বীকার হন শ্রাবণ। এজন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নং ওয়ার্ডে চার দিন চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।

শ্রাবণের অভিযোগ, হিজড়া পরিচয় দিলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে বলে শাসিয়েছিলেন তার ভাইয়েরা। বাসায় ঢুকতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর তিনি বাসায় ঢুকতে গেলে হামলার শিকার হন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাকে সম্পত্তি থেকে বিচ্যুত করার জন্য আমার ভাই ও চাচা যোগসাজশ করে আমার উপর হামলা চালিয়েছে। আমার ভাইরা চায় না, আমি পরিবারে থাকি। পরিবারে থাকলে নাকি সমাজ তাদের কবর দিতে আসবে না। তাদের ছেলে-মেয়েদের নাকি ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না। আমি হিজরা বলে নাকি সমাজে তাদের নানা কথা শুনতে হয়।”

শ্রাবণের অভিযোগের সত্যতা মেলে তার বড় ফুপু তপিরুন্নেছার কথায়।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ভাই বেঁচে থাকাকালীন কখনোই চায়নি ও (শ্রাবণ) হিজড়াদের সাথে চলে যাক। ভাই মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর সাথে অমানবিক অত্যাচার শুরু করেছে আমার ভাই-ভাতিজারা। এখন ওর ঘরটা কেড়ে নিতে চায়।”

শহীদ হোসেন শ্রাবণ।

মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে শ্রাবণের ছোট ভাই সজীব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাকে মারধর করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে ও পথ থেকে ফিরে আসতে।

“তার জন্য আমাদের বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ আসে এবং আমাদের বলে, তোমার ভাই হিজড়া। ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগে। ওকে ভালো করার জন্যই এত কিছু করা। ও যদি ওই পরিবেশে থাকতে চায়, তাহলে ও চলে যাক।”

শ্রাবণ হিজড়া নয় দাবি করে তিনি বলেন, “ও তো আমাদের ভাই, আমরা জানি, ও হিজড়া নয়। টাকা দিয়ে হয়ত ওরকম সার্টিফিকেট বানিয়েছে।”

শ্রাবণের উপর নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা শিকার করলেও তাতে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছেন তার চাচা জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওরা ভাইয়েরা ভাইয়েরা মারামারি করেছ। আমি কাউন্সিলারের অফিস থেকে এসে দেখি শ্রাবণ আমার দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে পুলিশ প্রশাসন এসেছে। ডেকে ওকে মেডিকেলে পাঠিয়ে দিই।”

রংপুরের নুরপুরের একটি ৩ রুম বিশিষ্ট চালাঘরে থাকছেন তৃতীয় লিঙ্গের ৪৭ জন মানুষ। তাদের অধিকাংশই বলছেন, সম্পত্তি দেবে না বলে তাদের পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্য আসমা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুরু থেকে সবকিছু ঠিক ছিল। বাবা, মা, ভাই, বোন একসাথেই থাকতাম। মা আমাকে খুবই সাপোর্ট করত এবং কখনোই চাইত না অন্যান্য হিজড়াদের মতো আমি রাস্তায় ভিক্ষা করি।

“আমি হস্তশিল্প ও গবাদি পশু পালন, এক কথায় বাড়ির সমস্ত কাজ করতে পারি। এসব করে আমি প্রায় নয় লাখ টাকার মতো জমিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে জমি বন্ধক নিয়েছিলাম। আমার ভাইয়েরা সেই টাকা তুলে আমাকে না বলেই ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যখন দেখেছে আমি অনেক উন্নতি করছি, তখন আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং সম্পত্তির অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে।”

এরপর বাড়িতে যতবার গিয়েছিলেন, ততবারই মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তার।

“আমার ভাইয়েরা বাবা-মাকে দেখে না। আমি ভিক্ষাবৃত্তি করে আমার বাবা মাকে দেখছি,” বলেন আসমা।

রংপুরের মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান নির্বাহী মুনির চৌধুরী সবক্ষেত্রে হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিচ্ছেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই যে শ্রাবণ, যাকে হিজড়া হওয়ার কারণে পরিবার থেকে নিগৃহীত করা হয়েছে এবং আহত করা হয়েছে, তারা কিন্তু মূলত অপরাধ করেছে। দেশের প্রচলিত যে দণ্ডবিধি, সেই দণ্ডবিধিতেই তাদের বিচার করা খুবই স্বাভাবিক।”

নাগরিক সংগঠন সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু হিজড়াদের পুনর্বাসনে সরকারি উদ্যোগে গতিশীলতা প্রত্যাশা করছেন।

রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন দাবি করছেন, হিজড়াদের জন্য তার দপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের জরিপ মতে, সারা বাংলাদেশে ১১ হাজার হিজড়া রয়েছে। সরকার হিজড়াকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি হিজড়াদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। অনেকটা সক্ষমও হয়েছি। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা এই কাজটি করে যাচ্ছি।”

কীভাবে কাজটি হচ্ছে- জানতে চাইলে মতিন বলেন, “আমরা সেই পরিবারগুলোকে বোঝাতে সচেষ্ট আছি যে এরা পরিবারের বাইরের অংশ নয়। আমরা বোঝাচ্ছি, যে পরিবারে এরকম শিশুর জন্ম হচ্ছে, এটা কোনও পাপ নয়। অনেক পরিবার এই বুঝতে পেরেছে।”

যারা সমাজচ্যুত কিংবা পরিবার বিচ্যুত হয়েছে, তাদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর হতে সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ্বলেও জানান তিনি।

শাম্মী-মৃত্তিকার ঘটনাও আলাদা নয়

ঢাকায় থাকা হিজড়া শাম্মী জানান, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে কীভাবে তার উপর ভাইয়ের অত্যাচার নেমে আসে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছোট ভাইকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছি। সেই ভাই কি না বড় হওয়ার পর বাবাকে বলে, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। ‘আমার বউ বাড়ি এসে কি একটা হিজড়ার মুখ দেখবে?’- মুখের ওপর বলেছে সে।”

শাম্মী চোখের পানি মুছতে মুছতেই বলতে থাকেন, “নিজে না খেয়ে ভাইকে খাইয়েছি, আগলে রেখেছি যতদিন পেরেছি। অথচ আজ আমার বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা সেই ভাই। সম্পত্তি থেকে আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি, সব কিছু ভাইয়ের নামে। আমাদের বসতবাড়ি ছাড়াও অন্যখানে এক খণ্ড জমি রয়েছে। সেখানে একটা ঘর করতে চেয়েছিলাম থাকার জন্য। সেটাও আমার ভাই বাবাকে করতে দেয়নি।”

বাধ্য হয়ে এখন হিজড়াদের ডেরায় আশ্রয় নিয়েছেন শাম্মী।

স্বীকৃতি পেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাতে রাজপথে হিজড়ারা।

আরেক হিজড়া মৃত্তিকার ক্ষেত্রেও ভাই হয়ে উঠেছিলেন ‘শত্রু’। সরকারি চাকুরে বাবার প্রথম সন্তান তিনি, তার ছোট দুই বোন আর এক ভাই।

মৃত্তিকা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছোট ভাইটাই একসময় শত্রু হলে উঠল। পরিবার থেকে ত্যাজ্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। এর প্রধান কারণ গ্রামের বাড়ির বিঘার পর বিঘা জমি।”

হিজড়া অধিকার যুব সংঘের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি (ববি হিজড়া) বলছেন, সম্পত্তিই তাদের বঞ্চনার মূল কারণ। কেননা আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে হিজড়াদের অধিকারের কথাটি স্পষ্ট বলা নেই।

মৃত্যুর পরও যে হিজড়াদের সঙ্কটের অবসান ঘটে না, সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মৃত্যুর পর এমনও হয়েছে, একটু মাটি দিতে চেয়ে কত মানুষের হাত-পা ধরতে হয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়েছে, তার জানাজা পর্যন্ত পড়াতে আসতে চায়নি হুজুর।

“একটু যদি সম্পত্তি থাকত, তাহলে হয়ত পরিবারের অন্যরা সম্পদের লোভে হলেও খোঁজ নিত। বাড়ি থেকে সারাজীবন দূরে থাকলেও মৃত্যুর পর বাড়ির আঙিনায় একটু জায়গা হত।”

প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে হিজড়ারা বলছেন, সবকিছু তো নারী-পুরুষের জন্য। সম্পত্তির যে আইন সেটাও ছেলে আর মেয়েদের জন্য। হিজড়াদের কথা তো কিছু বলা নেই।

ববি হিজড়া বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্পত্তি পাবে। কিন্তু সেখানেও বলা হয়েছে, কেউ যদি ছেলের পোশাক পরে, সে ছেলের অংশীদারত্ব আর যে মেয়ের পোশাক পরবে, তারা মেয়ের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সম্পত্তি পাবে।

“কিন্তু আমরা তো বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে যাই কিছু বোঝার আগেই। আমাদের বাবা-মার মৃত্যুর পর সম্পত্তির কথা উঠলে পরিবারের অন্যরা বলতে থাকে, ও তো হিজড়া হয়ে গেছে, ওর সম্পত্তির কী দরকার?”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত