অবস্থাটা এমন ছিল যে নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না উর্মির, ঘুম তো দূরের কথা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এই হিজড়া। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, ডাকসুর সাবেক জিএস মো. আখতারুজ্জামান।
জাঁদরেল রাজনীতিকদের সঙ্গে েভাটের লড়াইয়ে নেমেছেন, ভয় লাগছে না- সকাল সন্ধ্যার এই প্রশ্নে উর্মির উত্তর ছিল, “কাউকে না কাউকে, কখনও না কখনও সাহসী হতে হয়। সে সাহসটাই করে ফেলেছি এবার।”
সদ্য সমাপ্ত এই নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের আরেক প্রার্থী ছিলেন আনোয়ারা ইসলাম রানী, রংপুর-৩ আসনে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
রানীর ভোটের পথটি সহজ ছিল না। মিছিলে বাধা, মাইক কেড়ে নেওয়া, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার ঘটনার মধ্যদিয়ে লড়াইটি চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
লড়াইটি কঠিন হলেও তা করতে পারছেন হিজড়ারা। হিজড়া পরিচয়ে ভোটার হওয়া, এই পরিচয়ে প্রার্থী হওয়ার পথটি করে দিয়েছে তাদের সরকারি স্বীকৃতি।
নারী ও পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের সমাজের মূল স্রোতে স্থান দেওয়ার লক্ষ্যে এক দশক আগে তৃতীয় লিঙ্গের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার।
২০১৪ সালে প্রকাশিত এক গেজেটে বলা হয়েছিল, “সরকার বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে হিজড়া লিঙ্গ (Hijra) হিসাবে চিহ্নিত করিয়া স্বীকৃত প্রদান করিল।”
এই স্বীকৃতি হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মানের উন্নতিতে কী ভূমিকা রেখেছে? মূলধারায় কতটা তারা সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন? তাদের প্রতি বৈষম্য কতটা কমেছে? সেই প্রশ্নগুলো উঠছে এখন।
হিজড়ারা বলছেন, স্বীকৃতির কারণে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন। নিজের পরিচয়ে ভোট দিতে পারছেন। সরকারি ভাতাপ্রাপ্তির তালিকায় তাদের নাম যোগ হয়েছে। আর কিছু মেলেনি তাদের।
২০১৩ সালে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ২০১৩ সালে ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা’ প্রণয়ন করে সরকার।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। তাদের জন্য নেওয়া সরকারি নানা কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা এখন ৬ হাজারের বেশি।
নীতিমালার অধীনে যে সহায়তা
>> হিজড়া ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ ও পরিচয়পত্র প্রদান
>> ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের দুস্থ ও অসচ্ছল হিজড়া ব্যক্তিকে মাসিক ৬০০ টাকা হারে বিশেষ ভাতা প্রদান
>> হিজড়া শিক্ষার্থীদের মাসিক হারে প্রাথমিক স্তরে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ১০০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১২০০ টাকা হারে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান
>> কর্মক্ষম হিজড়া ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান, আর্থিক অনুদান প্রদান ও আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিতকরণ
>> প্রশিক্ষণোত্তর এককালীন নগদ সহায়তা হিসেবে ১০,০০০ টাকা প্রদান
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে দেশের ৬৪টি জেলায় হিজড়াদের ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
যা বলছেন হিজড়ারা
হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংগঠন ‘সুস্থ জীবন’ এর নির্বাহী পরিচালক ববি হিজড়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, স্বীকৃতিটা মুখে মুখেই। যাদের বয়স ৫০ বছর, তারা ভাতা পাচ্ছেন মাসে ৭০০ টাকা করে।
“কিন্তু এই যুগে ৭০০ টাকায় একজন মানুষ কীভাবে জীবন যাপন করতে পারে?”
কর্মসংস্থানসহ আরও অনেক আশ্বাস ছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
ববি বলেন, “আপনারা কেবল নিউজের কাজেই ডাকেন আমাদের, এনজিওসহ অন্যান্যরা ডাকে কথা বলতে, আলোচনা করতে। বছরের পর বছর ধরে কেবল কথাই হচ্ছে, কিন্তু আমাদের উন্নয়নের জন্য কিছু হচ্ছে না।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হিজড়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কেবল স্বীকৃতি দিয়েই যদি জীবন চালানো যেত, তাহলে হয়ত খুব ভালো থাকতাম। কিন্তু জীবন চালাতে গেলে তো পেট চালাতে হয়, পেট চালাতে গেলে লেখাপড়া লাগে, চিকিৎসা লাগে, বাড়ি ভাড়া লাগে। সেসবের কিছুই তো নেই আমাদের জন্য।
“তাহলে স্বীকৃতি দিয়ে লাভটা কী হলো? আমরা আসলে যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি।”
হিজড়াদের অধিকাংশই বলছেন, সম্পত্তিতে তাদের উত্তরাধিকার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় কারণে তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বেশি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীদের অধিকার সুরক্ষায় আইনের খসড়া করা হয়েছে। তবে সেটি প্রণয়ন করতে হবে দ্রুত। কারণ শুধু আইন করলেই হবে না, এর প্রয়োগ থাকতে হবে।”
ভারতে এই ধরনের বোর্ড গঠিত হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা সঠিক কর্মপরিধির দিকে আগাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন পারব না? আমাদেরও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা করে সেভাবে এগোতে হবে।”