সাত জেলায় দুদিনের অভিযান, তাতে অপহরণকারীদের কবল থেকে মুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান হিমেল। তাকে উদ্ধারের পাশাপাশি র্যাব গ্রেপ্তার করেছে এই অপহরণকাণ্ডের হোতাকে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার পাহাড়ি একটি গ্রাম থেকে হিমেলকে উদ্ধারের পরদিন বৃহস্পতিবার অভিযানের বিস্তারিত জানাতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন র্যাবের কর্মকর্তারা।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকার গহীন পাহাড়ে সুন্দরবন গ্রাম থেকে হিমেলকে উদ্ধার করি।
“এই গ্রামের অর্ধেক এলাকা ভারতে। ভারত আর বাংলাদেশে মিলে এই গ্রাম। তখনই স্বার্থকতা লেগেছে যখন অপহৃত হিমেলকে জীবিত তার মায়ের কোলে ফিরে দিতে পেরেছি।”
হিমেল অপহৃত হয়েছিলেন গত ২৬ ডিসেম্বর। ঢাকার উত্তরার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর তার মা তহুরা হক প্রথমে সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে গত ৬ জানুয়ারি তা অপহরণের মামলা হিসাবে নথিভুক্ত করে উত্তরা পশ্চিম থানা।
এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। অপহরণকারীরা হিমেলকে নির্যাতনের ভিডিও তার মাকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ চাইলে তা নিয়ে শোরগোল ওঠে। তখন হিমেলকে উদ্ধারে অভিযানে নামে র্যাব।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, “ঘটনার এক পর্যায়ে এসে আমরা এই অপহরণ মামলার ভিকটিম হিমেলের মায়ের তথ্যের উপর ভিত্তি করে মাঠে নামি। পরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ প্রায় ৭টি জেলাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।”
র্যাব-১ এর গোয়েন্দা শাখার পাশাপাশি র্যাব-৭ ও ৯ এর সদস্যরাও এই অভিযানে যুক্ত হন।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, “২৩ তারিখে চক্রের মূলহোতা মালেক ও ড্রাইভার সামিদুলকে গ্রেপ্তার করি আমরা। কিন্তু তখনও মেলেনি হিমেলের সন্ধান। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে চলে অভিযান। ভিকটিমের সন্ধান পাই আমরা। গতকাল রাতে ভিকটিমকে উদ্ধার করি।”
হিমেলকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়, সেখান থেকে রনি বসাক ও বিল্লাল নামে অপহরণকারী চক্রের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে র্যাব জানিয়েছে।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, “এই অভিযানে আমাদের র্যাব সদস্যদের দুইজন আহত হয়েছেন।”
গ্রেপ্তার এড়াতে বারবার স্থান পরিবর্তন
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তার এড়াতে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে আত্মগোপন করেছিলেন হিমেলকে অপহরণকারীরা। এতে সহযোগিতা করেন রনি বসাক।
চক্রের হোতা মালেকের বিরুদ্ধে অন্তত ১৪টি মামলা রয়েছে। আট বছর কারাভোগও করেন। রনির বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। চক্রের সবার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বলে জানায় র্যাব।
একবার অপহরণকাীরা ৩২ লাখ টাকা নিয়ে ময়মনসিংহের একটি স্থানে যেতে বলেছিলেন হিমেলের মাকে। তিনি সেই খবর র্যাবকে জানিয়েছিলেন।
টাকা নিয়ে তখন ঘটনাস্থলে যান হিমেলের মা। পাশে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। তবে তা টের পেয়ে স্থান পরিবর্তন করে অপহরণকারীরা। এরপর টাকা নিয়ে যেতে বলা হয় সিলেট সুনামগঞ্জের তাহেরপুরের গহীন জঙ্গলে।
অভিযান নিয়ে যা বলছে ডিবি পুলিশ
এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মঙ্গলবার বিকালে শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট থানার একটি চর থেকে মাসুদ নামে এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেন, যিনি অপহরণের পর হিমেলের গাড়িটি চালিয়ে গাজীপুরে ফেলে রেখেছিলেন।
মাসুদের দেওয়া তথ্যে আরও দুই আসামিকে সন্ধ্যায় ঢাকার তুরাগ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলেও ডিবি জানায়। কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছ থেকে তথ্য মেলে যে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানাধীন টাঙ্গুয়ার হাওরে একটি নৌকায় রয়েছে অপহরণ চক্রের মূল আসামিসহ চারজন।
যেভাবে অপহৃত হন হিমেল
হিমেলের বাসা উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে। তিনি পড়াশোনা করেন আইইউবিএটিতে। চার মাস আগে বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যাটারি ব্যবসায় যুক্ত হন তিনি। ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই গত ২৬ ডিসেম্বর নিজের প্রাইভেটকার নিয়ে শেরপুর যাচ্ছিলেন তিনি।
গাড়িটি চালাচ্ছিলেন হিমেলদের চালক সামিদুল। চার বছর আগে হিমেলের বাবাই চাকরি দিয়েছিলেন তাকে। সামিদুল ছিলেন ব্যাটারি বহনকারী পিকআপভ্যানের হেলপার।
হিমেলের বাবা নিজের টাকা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে তাকে নিজের গাড়িতে চাকরি দেন।
এই সামিদুলই অপহরণের পরিকল্পনাকারী বলে র্যাবের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
শেরপুরে সামিদুলের গ্রামের বাড়ির দিকে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন হিমেল। দুই ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ১১টার দিক থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান মা তহুরা হক। র্যাব জানিয়েছে, ওই দিন গাজীপুরের শালনা এলাকায় পৌঁছানো মাত্র পেছন দিক থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকজন হিমেলের গাড়ির গতিরোধ করে। পরে তাদের প্রাইভেটকারের নিয়ন্ত্রণ নেয় অপহরণকারীরা। এরপর গাড়ি চলে ময়মনসিংহের দিকে।
তখন গাড়িতে চালকের আসনে বসেন রাসেল। আর ভেতরে বসেন বিল্লালসহ দুজন। চক্রের অন্যরা মোটরসাইকেলে করে তাদের অনুসরণ করতে থাকেন। চক্রের হোতা মালেক গাড়িতেই হিমেলের উপর নির্যাতন শুধু করেন।
নির্যাতনের ভিডিও মায়ের কাছে
ভারতের একটি হোয়াটঅ্যাপ নম্বর থেকে কল করে ছেলেকে নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দাবি করেছিল অপহরণকারীরা। এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন নির্যাতন।
তহুরা জানান, কখনও হাত-পা বেঁধে, মাথা নিচে পা উপরে করে ঝুলিয়ে পেটানোর ভিডিও, কখনও চোখ বেঁধে হাত-পা বেঁধে পেটানোর ভিডিও দেওয়া হত।
এমন ভিডিও-ও এসেছিল, যেখানে হিমেল বলছিলেন, “মা আমাকে বাঁচাও, ওরা (অপহরণকারীরা) যা চায় দিয়ে দাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”