Beta
মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪

দাবদাহে পুড়ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

Heat
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

[publishpress_authors_box]

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। তীব্র দাবদাহ ও খরা পরিস্থিতিতে বেসামাল এখন ওই অঞ্চলের জনজীবন।

এমনটা যে হবে, সেই হুঁশিয়ারি গত দুই দশক ধরেই দিয়ে আসছিলেন পরিবেশবিদরা। কিন্তু মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ায় এখন ভুগতে হচ্ছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপিন্সে তীব্র দাবদাহের কারণে কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় দীর্ঘ খরায় ধানের দাম আকাশচুম্বী। গত কয়েক মাসে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

থাইল্যান্ডেও পড়েছে তীব্র খরার প্রভাব। সেখানে উপকূলীয় এলাকায় পানির তাপমাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখন ‘ঐতিহাসিক দাবদাহ’ চলছে বলে দাবি করছেন জলবায়ুবিজ্ঞানী ম্যাক্সিমিলিয়ানো হেরেরা।

সম্প্রতি তিনি সোশাল মিডিয়া এক্সে বলেন, “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে এপ্রিল মাসের শুরুতে এত বেশি তাপমাত্রা আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের মিনবু এলাকা। সেখানে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়ার ইতিহাসে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে এত বেশি তাপমাত্রা আগে রেকর্ড হয়নি।”

থাইল্যান্ডের সর্বদক্ষিণের অঞ্চল হাত ইয়াতে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম ভিয়েতনামের ইয়েন চাউয়ে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে, যা এই সময়ের জন্য অভাবনীয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যে ‘দাবদাহের’ কবলে পড়বে তা গত ফেব্রুয়ারিতেই সতর্ক করেছিল বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। ওই সময় তাপমাত্রা বারবার ৩০ ডিগ্রির উপরে উঠেছিল, যা এই ঋতুতে গড় তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। সংস্থাটি এই দাবদাহের জন্য মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও এল নিনোকে দায়ী করেছে।

সিঙ্গাপুরের আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক অধ্যাপক বেঞ্জামিন হর্টন বলেন, “গত ১২ মাসে পৃথিবী, স্থল ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই যে পরিমাণ তাপ অনুভব করেছে, তা বিজ্ঞানীদের হতবাক করেছে।

“ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি, তা আমরা আগেই জানতাম। কিন্তু ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তাপমাত্রার সব রেকর্ড ভেঙে যাওয়াটা আশঙ্কাজনকভাবে দ্রুত ঘটছে। বিশ্বের খুব কম জায়গা আছে যা এমন তীব্র দাবদাহ সইতে পারে। আমরা এখনও এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি।”

এই তীব্র দাবদাহ মোকাবেলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলোর চিন্তার বিষয়। ফিলিপিন্সের কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ায় প্রায় চার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া দপ্তর সতর্ক করেছে, এই বিপজ্জনক মাত্রার তাপে শরীরে খিঁচুনি ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।

শিক্ষকদের ইউনিয়ন অ্যালায়েন্স অব কন্সার্নড টিচার্সের (এসিটি) সভাপতি রুবি বার্নার্দো বলেন, “এমন আবহাওয়ায় আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো টিকে থাকার মতো সক্ষম নয়। শ্রেণিকক্ষগুলোতে ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থীর অনুপাতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই।”

ইউনিয়নের করা জরিপে ৯০ শতাংশ শিক্ষকই জানিয়েছেন, তাদের শ্রেণিকক্ষে গরম থেকে রক্ষা পেতে মাত্র দুটি বৈদ্যুতিক পাখা রয়েছে।

তীব্র দাবদাহের কারণে মাথা ঘোরা ও ব্যথার অভিজ্ঞতার কথা জানান শিক্ষকরা। তারা আরও জানান, এমন তাপমাত্রার মধ্যে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়াসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

এসিটি স্কুলের সময়সূচি মহামারি-পূর্ব সময়সূচিতে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে গরম মাসগুলোতে ছুটিতে থাকতে পারে। সরকার ধীরে ধীরে এই দাবি বাস্তবায়ন করছে।

অধ্যাপক হর্টনের মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্কুল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থী ও কর্মীদের ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ক্লাস বা অফিসের সময়সূচি পরিবর্তন করে সকাল বা বিকালে নেওয়া যেতে পারে, যখন তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা যদি আজই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিই, তবুও আমাদের অন্তত ৫০ বছর ধরে তীব্র দাবদাহের মুখোমুখি হতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে কীভাবে এবং কোথায় শীতলতার মধ্যে থাকা যাবে, সে সম্পর্কে শিক্ষিত করতে আরও বেশি চেষ্টা প্রয়োজন।”

তীব্র দাবদাহ শুধু মানুষের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি কৃষিক্ষেত্রেও বিরাট বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে ধান চাষে সমস্যা দেখা দেয়। বৃষ্টি শুরু হলে ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো সেনাবাহিনীকে কৃষকদের সহায়তার নির্দেশ দেন।

রয়টার্স বলছে, ২৬ কোটি মানুষের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চালের দাম ১৬ শতাংশ বেড়েছে। সরকারি ভর্তুকি মূল্যে চাল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে জনগণকে।

ভিয়েতনামে খালের পানির স্তর এত কমেছে যে অনেক এলাকার কৃষকরা তাদের ফসল পরিবহনে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ব্যাংকক পোস্ট বলছে, থাইল্যান্ডে ফসলের উৎপাদন কমায় এ বছর কৃষকদের ঋণ ৮ শতাংশ বাড়বে। আর মালয়েশিয়ায় বৃষ্টির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কর্তৃপক্ষ কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টির পদ্ধতি ব্যবহার করছে।

দাবদাহের কারণে সরকারগুলো মানুষকে হিট স্ট্রোক এড়ানোর উপায় সম্পর্কে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে। যদিও অনেক শ্রমিক, বিশেষ করে কৃষি বা নির্মাণের মতো খাতে কর্মরতদের এই তীব্র তাপ সহ্য করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় একজন ২২ বছর বয়সী যুবক হিট স্ট্রোকে মারা যান।

দাবদাহের প্রভাব শুধু স্থলভাগেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমুদ্রের পানিকেও প্রভাবিত করছে। থাইল্যান্ডের কাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটির মৎস্যবিদ্যা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক থন থামরোংনাওয়াসাওয়াট এই সপ্তাহে সোশাল মিডিয়ায় সতর্ক করেছেন যে, এল নিনো ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন একইসঙ্গে থাইল্যান্ডের উপসাগরের প্রবাল ও মাছ ধ্বংসের ঝুঁকি তৈরি করছে।

তিনি বলেন, “গত বছরের এপ্রিলের শুরুর তুলনায় পূর্বাঞ্চলের পানির তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়েছে। এটি অস্বাভাবিক রকম উষ্ণ। এমনকি রাতের বেলাও তাপমাত্রা ছিল ৩১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।”

এই তীব্র দাবদাহ আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ চললে প্রবাল প্রাচীর থেকে শেওলা বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অতিরিক্ত উত্তপ্ত পানি স্থানীয় মাছের খামারগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং কৃষকদের ঋণের জালে আবদ্ধ করছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত