Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

হিটলার, স্ট্যালিন, শি, মাউন্টব্যাটেনের জীবন থেকে নেয়া

এডলফ হিটলার, যোসেফ স্ট্যালিন, শি জিন পিং, লুই মাউন্টব্যাটেন।

এডলফ হিটলার মায়ের মৃত্যুতে ব্যথাতুর হয়ে মৃত মায়ের ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ফ্রন্টে হিটলারের মৃত্যু সংবাদ শুনেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে দেননি যোসেফ স্ট্যালিন। শি জিন পিং নিজেই বলেছেন শৈশবে তিনি খুব স্বার্থপর ছিলেন। আর ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার ক্ষণে লুই মাউন্টব্যাটেন নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন ‘পণ্ডিত’ হিসেবে! বিশ্বমঞ্চে বহুল আলোচিত চার ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে নেয়া কিছু কথা তুলে ধরেছেন আন্দালিব রাশদী

মানবিক তরুণ এডলফ হিটলার

১৯০৬ সালে ক্লারা তার স্তনে জমাট একটি মাংশপিণ্ডের উপস্থিতি টের পেলেন। তিনি এটাকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। ১৯০৭-এর জানুয়ারিতে অসহ্য ব্যথায় ছটফট করতে এক সময় পারিবারিক চিকিৎসক ডক্টর ব্লখের শরণাপন্ন হলেন। তিনি যা বললেন তাতে আশার বাণী কমই। কপাল ভালো হলে ম্যাস্টেকটমি (স্তন অপসারণ) থেকে রক্ষা হতে পারে। ক্লারার ছেলে অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালে অষ্ট্রিয়াতে। তার জীবনের ২৪ বছর কেটেছে অষ্ট্রিয়াতে। ১৯১৩-তে জার্মানিতে বসতি স্থাপন করেন। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর থেকে মূলত তিনিই পরিবার প্রধান হয়ে উঠেন।

ডক্টর ব্লখ লিখেছেন, আমার কথা শুনে ছেলেটার লম্বা মুখ পাণ্ডুর ও বিকৃতি হয়ে উঠল, তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, তার মায়ের কি কোনো আশা নেই?

দুর্ভাগ্য ক্লারার। অপরেশনের পর দেখা গেল ক্যান্সার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সময় হিটলার ভিয়েনা থেকে মায়ের কাছে চলে এলেন। পরবর্তী মাসগুলোর জন্য তিনিই মায়ের সার্বক্ষণিক নার্স ও কেয়ারটেকার। তিনি রান্না করতেন, ঘরবাড়ি পরিস্কার করতেন। শয্যাশায়ী মায়ের পাশে চেয়ার পেতে বসে থাকতেন। রাতে চেয়ারে ঠেস দিয়ে ঘুমোতেন পাছে মায়ের কিছু প্রয়োজন হয়। ডক্টর ব্লখ লিখছেন, ছেলেটির চোখ অশ্রুভরাক্রান্ত এবং লালচে রঙ ধরেছে ক্লান্তিও পেয়ে বসেছে। আমি যা বলছি তার সব শুনে জিজ্ঞেস করল, আমার মা কি খুব কষ্ট পাচ্ছেন?

ক্লারার অবস্থা একেবার প্রান্তে এসে ঠেকেছে। ডাক্তার একটি চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নিতে চাইলেন। তিনি আয়োডোফর্ম ক্যামোথেরাপি প্রয়োগ করবেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আর কোনও উপায় নেই জেনে ছেলেই অনুমতি দিলেন।

ক্লারা হিটলার ও এডলফ হিটলার।

আয়োডফর্মে চুবানো গজ ক্ষতের উপর এই উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা যে তা ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করবে। এই চিকিৎসা তার যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিল, তিনি খাবার গেলার শক্তি হারালেন। ডাক্তার লিখছেন, মায়ের চেহারায় ফুটে উঠা যন্ত্রণার সবটাই তার ছেলের চেহারার মধ্যেও প্রতিফলিত হতে থাকে। তেমন কিছু আর করারও নেই। মরফিন ইনজেকশন যন্ত্রণার সাময়িক প্রশমন এনে দিতে পারে। কিন্তু তা বড্ড স্বল্পকালীন। কিছুটা সময় যে মায়ের যন্ত্রণা কমে যাচ্ছে, তাতেই অ্যাডলফ হিটলারের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

২০ ডিসেম্বর ১৯০৭ রাতের বেলায় ক্লারার শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। অ্যাডলফ বেদনাবিধুর। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল মায়ের পাশে বসে অ্যাডলফ তার ছবি আঁকছেন। ছবি আঁকা শেষ হলেই তার মৃতদেহ সরাবার অনুমতি দেওয়া হলো।

আমার চিকিৎসক জীবনে তার মতো এমন ব্যাথতুর কাউকে দেখিনি। ১৮ বছর বয়সী অ্যাডলফ ডাক্তারকে বললেন, ‘আমি আপনার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব’।

ডাক্তার ব্লখ ছিলেন ইহুদি। হিটলার বলতেন, ‘নোবেল জু’। তিনি ইহুদি বৈষম্যের খাতায় তাকে আনেননি। তিনি যখন আমেরিকা যেতে চাইলেন তার লাইসেন্স এবং অর্থ কড়িসহ যেতে দেওয়া হলো। মায়ের মৃত্যুর পর ব্যক্তিগতভাবে তার ভেতর ক্যান্সারের ভয় ঢুকে গেল। মাংস, অ্যালকোহল এবং সিগারেট ক্যান্সারের কারণ হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে তিনি এসব আর মুখে তুললেন না। চ্যান্সেলর হয়ে জার্মানিতে স্মরণকালের বৃহত্তম ধূমপান বিরোধী প্রচারণা তিনি চালালেন। তাদের আশে পাশের সকলকে এই তিনটি বিপদজনক দ্রব্য থেকে বেরিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ তার মৃত্যু পর্যন্ত মায়ের একটি ছবি সব সময়ই সাথে রেখেছেন। অ্যাডলফ হিটলারের    এটাও একটা  দিক।

হিটলারের মৃত্যু সংবাদে স্ট্যালিনের সাড়া

অ্যান্টনি বিভরের লেখা ‘দ্য ফল অব বার্লিন’ থেকে নেয়া একটি অংশ:

৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ রাতের বেলা মার্শাল জুকভ সবচেয়ে বড় খবরটা দিতে স্ট্যালিনের সাথে কথা বলতে চাইলেন। স্ট্যালিনের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকতা জেনারেল ভ্লাসিক ফোনটা ধরলেন এবং জুকভকে বললেন কমরেড স্ট্যালিন মাত্র বিছানায় গেছেন। জুকভ বললেন, তাকে তাড়াতাড়ি জাগাও। ব্যাপারটা খুবই জরুরি। এটা নিয়ে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভ্লাসিক স্ট্যালিনকে জাগাতে গেলেন। স্ট্যালিন জুকভের ফোন ধরে শুনলেন এবং বললেন, যা হবার তো হয়েই গেছে। যাই করো হিটলারের দেহে তো আর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এখন বলো তার লাশটা কোথায়?

জুকভ বললেন, জেনারেল ক্রেবস বলেছেন লাশটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

হ্যানস ক্রেবস জার্মান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ। সোভিয়েত জেনারেলদের হিটলারের মৃত্যু সংবাদ তিনিই দিয়েছেন।

স্ট্যালিন জুকভকে বললেন, শকোলোভিস্কিকে বলো, নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ছাড়া আর কোনও সমঝোতা নয়। এটা ক্রেবস কিংবা হিটলারের অন্য কোনও জেনারেলকে বলো। মারাত্মক কিছু না হলে কাল সকালের আগে আমাকে ফোন করবে না। কাল সকালে প্যারেড আছে। আমাকে ঘুমোতে দাও।

শকোলোভস্কি হচ্ছেন জুকভের ডেপুটি ফ্রন্ট কমান্ডার। হিটলারের মৃত্যু সংবাদে স্ট্যালিন কিছুটা তৃপ্তি পেতে পারেন। কিন্তু আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেননি। এটাকে তিনি তেমন জরুরি কিছু মনে করেননি যার জন্য তার রাতের ঘুমটা নষ্ট করতে হবে।

শৈশবে বাবার সঙ্গে শি জিন পিং (বা দিকে দাঁড়ানো)।

শি জিন পিং এর শৈশবের গল্প

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং লিখছেন : যখন আমি ছোট বালক ছিলাম, খুব স্বার্থপর ছিলাম। সব সময় সবচেয়ে ভালোটা নিজের জন্য কেড়ে নিতাম। ফলে ধীরে ধীরে সবাই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। আমার আর কোনও বন্ধু নেই। এটা যে আমার দোষ তা তখনও বুঝিনি, বরং আমি অন্যের সমালোচনা করতে থাকি।

একদিন আমার বাবা দুই বাটি লুডলস রান্না করে টেবিলের উপর রাখলেন। একটি বাটিতে নুডলসের উপর একটি ডিম দেখা যাচ্ছে। অন্যটির উপরে ডিমের দেখা নেই।

বাবা বললেন, তুমি কোন বাটি নেবে নাও।

সে কালে সাধারণ সময়ের খাবারে ডিম পাওয়া একটি দুর্লভ ব্যাপার। আমরা কেবল নববর্ষের উৎসবে পেতাম।

কোনও সন্দেহ নেই, আমি ডিম আছে এমন বাটিটাই পছন্দ করেছি।

আমরা যখন খেতে শুরু করি আমার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে অভিনন্দন জানাই এবং পুরো ডিমটা খেয়ে ফেলি।

পণ্ডিত মাউন্টব্যাটেন কি জয়!

মাউন্টব্যাটেনের ভাষ্য:

১৯৪৭-এর ১৩ আগষ্ট রাতে করাচিতে ৬০ জনের একটি স্টেট ব্যাঙ্কোয়েট সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠিত হয়। আগেই সম্মতি জ্ঞাপন করা হয় যে কোনও বক্তৃতা হবে না, হবে কেবল দুটো টোস্ট। আমার তখনকার আতঙ্কের কথা ভাবুন, যখন দেখলাম  ঘন করে টাইপ করা আধ ডজন কাগজের পাতা জিন্নাহ সাহেব পকেট থেকে বের করলেন এবং ভাষণ দেবার জন্য এগোলেন। যাই হোক সবশেষে রাজার সুস্বাস্থ্য কামনা করে তিনি টোস্ট করলেন। আমাকে একটি তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিতে হলো এবং শেষে পাকিস্তানের সুস্বাস্থ্য কামনা। এই বাঙ্কোয়েটের পরপরই একটি সম্বর্ধনা, তাতে ১৫০০ শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি নাগরিক উপস্থিত থাকরেন: দেখতে জংলি এমন কিছু মানুষও তাদের মধ্যে হাজির ছিলেন।

আমি জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহ ও বেগম লিয়াকত আলী খান (প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী)-এর মাঝে বসেছিলাম। ভারতের স্বাধীনতার দিল্লির উৎসব অনুষ্ঠান যে মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নিয়ে দুজনই আমাকে খোঁচাচ্ছিলেন। বললেন, কী বিষ্ময়কর ব্যাপার! এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্য এমন একটি দায়িত্বপূর্ণ সরকার গণকের নির্দেশনার উপর নির্ভর করে? আমি করাচির অনুষ্ঠান নিয়ে তির্যক মন্তব্য করা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করি। জিন্নাহ ভুলে গিয়েছিলেন যে এটা রমযান মাস আর তিনি লাঞ্চ পার্টির আয়োজন করতে বলেছিলেন। পরে এটাকে বদলে ডিনার পার্টি করতে হয়েছে।

জওয়াহের লাল নেহরু ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে লুই মাউন্টব্যাটেন।

এবার দিল্লির অনুষ্ঠান:

সামান্য খানিকটা পথ যেতে আমাদের আধঘন্টা সময় লেগে গেল। জনতার ভিড় কোচের গতি শ্লথ করে দিয়েছে। মানুষের চাপে এক জায়গায় আমরা পাঁচ মিনিট আটকা পড়ে থাকলাম। নিত্যকার শ্লোগান ‘জয় হিন্দ’, ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’এবং ‘পণ্ডিত নেহরু কি জয়’-এর সাথে বিস্ময়কর ধ্বনি উঠল, ‘মাউন্টব্যাটেন কি জয়’ ‘লেডি মাউন্টব্যাটেন কি জয়’ এবং একাধিকবার শোনা গেল ‘পণ্ডিত মাউন্টব্যাটেন কি জয়’।

জনতার ভিড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমাদের কোচ যদি এখান থেকে সরে যায় জনতারও একটি অংশ অবশ্যই অনুসরণ করতে করতে চলে আসবে। আমাদের কোচে উঠার জন্য নেহরুকে ডাকি। তিনি স্কুল বালকের মতো সিটের উপরের দিকে সামনের হুডে বসেন। বডিগার্ড ধীরে ধীরে কোচ এগোবার মতো রাস্তার মুখ খুলতে থাকে। হাজার হাজার লোক আমাদের দুপাশে ছুটছে, এ এক বিষ্ময়কর দৃশ্য। তারা তিন মাইল ছুটে এসে গভর্নমেন্ট হাউসের সামনে থামতে বাধ্য হয়। পুলিশ তাদের আর ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।

৯ আগষ্ট ১৯৪৭ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তার পার্সোনাল রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন ‘ভারতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ নির্ধারণের জন্য আমাকে ভাগ্য গণনাকারীর দ্বারস্ত হতে হবে এমন কোনও সতর্ক সঙ্কেত আমাকে আগে দেওয়া হয়নি। জ্যোতিষীরা জানিয়ে দিলেন ১৩ ও ১৫ আগস্ট অশুভ, ১৮ তারিখ মধ্যরাত পর্যন্ত শুভ। সুতরাং ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ভারতীয় কনস্টিটিয়েন্ট অ্যাসেম্বলি মধ্যরাতের একটু আগে বৈঠকে বসল। মধ্যরাতে দিল্লির আকাশে আতশবাজির খেলা, তখন বোঝা যায়নি এর পরই দিল্লিতে শুরু হবে সাম্প্রদায়িকতার নির্মম রক্তারক্তি খেলা।

মাউন্টব্যাটেনকে নিয়ে কুলদীপ নায়ার:

সাতচল্লিশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে লক্ষ মানুষের বয়ে যাওয়া রক্তগঙ্গার দায় কার? কুলদীপ নায়ার লিখেছেন ‘মাউন্টব্যাটেনের বিচার হলে তা ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষের মনের যে ক্ষত তার প্রশমন ঘটতে পারে। তারা এখনও বিশ্বাস করে লাখো মানুষের রক্ত মাউন্টব্যাটেনের মাথায়’।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
ইমেইল: momen98765@gmail.com

আন্দালিব রাশদী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত