Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বিকেএসপির সৌজন্যে বেঁচে আছে হকি

জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় উঠে এসেছে বিকেএসপি থেকে। ছবি:  সংগৃহীত।
জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় উঠে এসেছে বিকেএসপি থেকে। ছবি: সংগৃহীত।
[publishpress_authors_box]

“আগে জাতীয় দলের ক্যাম্প ডাকলে কিছু থাকত বিকেএসপির খেলোয়াড়। বাকিরা আসত জেলা থেকে। অথচ এখন জাতীয় দলের ১৮ জনই বিকেএসপির।”- ব্যাপারটা যতোটা না গর্বের এর চেয়েও বেশি হতাশার বলে মনে করেন বিকেএসপির হকি কোচ জাহিদ হোসেন রাজু।

বিকেএসপিময় হকি লিগ

মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে চলমান প্রিমিয়ার হকি লিগও যেন বিকেএসপিময়। এই মৌসুমের হকি লিগে মোট ১১টি দল অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে শুধু দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের কোনও খেলোয়াড় নেই বিকেএসপির। বাকি ১০টি দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই বিকেএসপির।

১১টি ক্লাবে সব মিলিয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২৪৩ জন। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড় মিলিয়ে বিকেএসপিরই ১১৫ জন। আর বিকেএসপির বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিদেশি মিলিয়ে ১২৮ জন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, লিগে শতকরা ৪৭ ভাগের বেশি খেলোয়াড়ের যোগান দিয়েছে বিকেএসপি ।  

১ ঘন্টার ম্যাচ গড়িয়েছে ৩ ঘন্টায়! প্রায় প্রতি ম্যাচেই খেলার নামে তামাশাই হয় বেশি। ছবি: সংগৃহীত।

এই পরিসংখ্যানই বলছে, বিকেএসপি ছাড়া হকি অচল। এই ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাটি না থাকলে কী হতো? এক হকি খেলোয়াড় নিজের খেলা ও জীবনের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন এভাবে, “বিকেএসপি না থাকলে খেলাটাই থাকতো না। তখন আমাদের ভবিষ্যৎটাও অন্ধকারের দিকে যেত না। ২০-২৫ হাজার টাকায় লিগ খেলতে হতো না। আমরা হয়তো অন্য কিছুতে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে নিতে পারতাম।” যারা খেলাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারাও সুখে নেই। এই হকি খেলে জীবন ও জীবিকার কোনও মানে খুঁজে পান না। হকি ছেড়ে যেন তারাও পালাতে চাইছেন !

বর্তমান জাতীয় দল সহ প্রতিটি ক্লাবেই বিকেএসপির দাপট। অথচ ফরিদপুর থেকে উঠে এসে এক সময় মাঠ মাতিয়েছেন মাহবুব হারুন, ইসা মিয়া, মুসা মিয়ারা। পুরনো ঢাকার আবদুস সাদেক, রফিকুল ইসলাম কামাল, ইরতেজা কাদের গুড্ডুদের কেউই ছিলেন না বিকেএসপির।

হকি ফেডারেশনের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইউসুফ আলী সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে স্মৃতিচারণ করেছেন, “ইসা, মুসা, কামাল, হারুনদের কেউই তো বিকেএসপিতে পড়েনি। বাংলাদেশের হকির সুতিকাগারের বড় জায়গা আরমানিটোলা মৃত। রাজশাহীর বৈকালী সংঘও অচল। ফরিদপুরের কমলাপুরেও খেলা নেই। বিকেএসপি ছাড়া তাই স্থানীয় খেলোয়াড় আর পাওয়া যাবে না। খেলাটির খুবই দুরবস্থা। কিন্তু বিকেএসপির নবম ও দশম শ্রেণীর খেলোয়াড়রাই এখন খেলছে। এতে কোনও লাভ হচ্ছে না। ফুল ফোটার আগেই তাদের মাঠে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

জেলাগুলোও হকি বিমুখ

অথচ নব্বইয়ের দশকে ঢাকার আরমানিটোলা, রাজশাহী, দিনাজপুর, ফরিদপুর, যশোর, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রামে ব্যাপক চর্চা হতো হকির। জাতীয় দল ও ক্লাব হকিতে বিকেএসপির পাশাপাশি এইসব জেলার খেলোয়াড়দের মধ্যে হতো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যা বাংলাদেশ দলের পাইপলাইন পোক্ত করত। এখন সেসব জেলায় হকি খেলা নেই। ওখান থেকে ঘরোয়া লিগে আর সেভাবে খেলোয়াড় আসে না। জেলার দুয়ারগুলো একে একে বন্ধ হচ্ছে আর আর বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের অক্ষমতার চিত্রটা প্রকট হচ্ছে ভীষণভাবে। উল্টো তাদের নোংরামি ও অন্তর্দ্বন্দ্বে খেলাটার অবস্থা যায় যায়। 

এমনকি ঢাকার হকির খেলোয়াড় তৈরির মূল কারখানা আরমানিটোলা মাঠেও আগের মতো খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। ১৯৮৫ সাল থেকে আরমানিটোলা মাঠে হকি খেলোয়াড় তৈরি করে আসছেন ফজলুল ইসলাম বা ওস্তাদ ফজলু। প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ এবং দ্বিতীয় বিভাগ অনিয়মিত হয়ে পড়ার প্রভাব পড়েছে আরমানিটোলা মাঠেও।

জেলায় জেলায় হকির চারণভূমিতে খেলাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, হকি ফেডারেশন ঢাকায় লিগ ও জাতীয় টুর্নামেন্টগুলো নিয়মিত করতে না পারার ফলেই মূলত হকি খেলোয়াড় সঙ্কট। তাই দেশের হকি এখন বেঁচে আছে বিকেএসপির কল্যাণেই।

প্রকৃত সংগঠকদের অভাবেই বিকেএসপির হকি নির্ভরতা বাড়ছে বলে মনে করে সাবেক হকি কোচ কাওসার আলী। বিকেএসপির সাবেক কোচ বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন যশোরে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে দূরে থেকেও হকির দুরবস্থা দেখে খারাপ লাগে তার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হকির উন্নতি করতে হবে। কিন্তু এর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই। হকির চর্চাটাই তো নেই। এসব দেখে খারাপ লাগে। আসলে যারা হকি নিয়ে কাজ করবে তারা অতটা সংগঠক হিসেবেও মাঠে নেই। তবু বিকেএসপি আছে বলে হকির মান একটু হলেও আছে।”

একপেশে লিগ

লিগে ১১ দল অংশ নিলেও একপেশে লড়াই হচ্ছে মাঠে। কোনও আকর্ষণই নেই হকি লিগে। তলানির দলগুলো যেখানে প্রতিপক্ষের জাল খুঁজতেই হিমশিম খায় সেখানে আবাহনী, মোহামেডান, মেরিনার্স ও ঊষা- এই ৪ দল গোল বন্যায় ভাসিয়েছে।

মোহামেডানের গোল উৎসবের ম্যাচ। ছোট দলগুলোর জালে বড় ৪ দল এমন উৎসব করেই আসছে। ছবি: সংগৃহীত।

এই ৪টি দল সুপার সিক্সের আগ পর্যন্ত ৯টি করে ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৬টি গোল দিয়েছে মেরিনার্স। এরপর আবাহনী প্রতিপক্ষের জালে ৫৯ গোল দিয়েছে। ঊষা ৫২টি ও মোহামেডান দিয়েছে ৪৬টি গোল। এমন একপেশে লড়াই দেখে হতাশ বিএসপির কোচ জাহিদ হোসেন রাজু, “ঢাকার মাঠে কেমন খেলা হচ্ছে? প্রথম ৫টা দলের পর অন্য দলগুলোর গোল পার্থক্য দেখলেই অনেক উত্তর পাওয়া যাবে। আসলে এবার প্রিমিয়ার লিগে যারা খেলছে তারা প্রথম বা দ্বিতীয় বিভাগেও খেলার যোগ্য নয়। যার যেখানে খেলার দরকার সে যদি সেখানে খেলত তাহলে খেলার মান ধরে রাখা যেত। ভালো কিছু হতো।”

ভিক্টোরিয়ার কোচ তাবিব-এ নূর হকির নিষ্ঠুর নিয়তি দেখছেন, “১৫-২০ বছর আগে আমরা যখন খেলেছি তখনও প্রত্যেক খেলোয়াড় ৮০ হাজার, ১ লাখ টাকা করে পেত। এখন মাঝারি মান থেকে নীচের দলগুলো প্রতি খেলোয়াড়কে ১৫-২০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে ক্লাবগুলো। এমন হলে খেলোয়াড়রাই-বা কেন খেলবে আর হকিই-বা কীভাবে বাঁচবে।” 

সত্যি হকির বেঁচে থাকা বড় কঠিন। আপাতত বিকেএসপির ছেলেপুলেরা অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত