বাস্তবে এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে কোনো নারীকে পায়নি আমেরিকা। অথচ একশ বছর আগের এক সিনেমার গল্প এগিয়েছিল আমেরিকায় নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্টকে ঘিরে।
১৯২৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ’। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের এই কমেডি সিনেমার পরিচালক ছিলেন জি জি ব্লাইস্টোন। আর আর্ল ফক্স কাজ করেছেন ‘এলমার’ চরিত্রে।
সিনেমা এগিয়ে চলে ভবিষ্যত সময়ে; ১৯৫৪ সালে এলমার ‘ম্যাসকুলিটিস’ রোগে মারা না যাওয়া একমাত্র পুরুষ। এই রোগের ভাইরাস যখন বিশ্বজুড়ে হানা দেয় তখন সে এক জঙ্গলে বাস করছিল। তাকে জঙ্গল থেকে শহরে আনা হয়। আর সরকার তাকে এক কোটি ডলারে কিনে নেয়। এদিকে দুজন ‘সিনেট্রেস’ (সিনেটর) তাকে বিয়ে করতে চায়। কে বিয়ে করবে তা নির্ধারণে বক্সিং ম্যাচে মুখোমুখি হয় তারা। যদিও এলমারের মনে জায়গা করে আছে তার শৈশবের প্রিয়তমা।
জন ডি সোয়েনের ছোট গল্পের অবলম্বনে ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ’ হলো নারীর কামনার মধ্যমণি হয়ে উঠতে পুরুষের অভিলাষী মন নিয়ে হাস্যরসাত্মক সিনেমা।
“তারা যে যৌনতাড়নায় কাতর তা ঢাকার এতটুকু প্রচেষ্টা ছিল না” – এই ‘অশ্লীল’ ও ‘কুরুচিপূর্ণ’ সিনেমা নিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ভার্জিনিয়া স্টেট বোর্ড অব সেন্সরস।
যদিও এই সিনেমা সেই সমাজ নিয়েও বিদ্রুপ করেছিল যেখানে নারীই সবকিছুর হর্তাকর্তা।
সিনেমায় অগোছালো হোয়াইট হাউস দেখানো হয়েছে; যেখানে প্রেসিডেন্ট মার্থা ম্যাটটক্স দেশ পরিচালনার চেয়ে রাস্তার বিড়ালের যত্ন নিতেই ব্যস্ত থাকেন বেশি।
সাহিত্যে নারীর রূপায়ন বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি পরিচালক ইরিকা কর্নেলিয়াস স্মিথ বললেন, “কল্পনা করে দেখুন, নারীরা বক্সিং করছে, সরকারেও বসছে।
“এসব দর্শকরা মেনে নিতো কারণ তারা ধরেই নিতো এ ধরনের কিছু কখনই ঘটবে না।”
বিংশ শতকের বাকি সময়ে বড় পর্দায় খুব বেশি নারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখা যায়নি। ১৯৩২ এবং ১৯৪৮ সালে হোয়াইট হাউসে ‘বেটি বুপ’ এবং ‘অলিভ অয়েলে’-এর অল্প সময়ের অ্যানিমেটেড উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। এর বাইরে হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতারা প্রেসিডেন্ট চরিত্রে পুরুষকেই বেছে নিয়েছেন।
স্মিথ বলেন, “জনপ্রিয় সংস্কৃতি মানে সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি এবং সম্ভাবনার একটি জায়গা।
“কিন্তু ব্যবসার জন্য বিজ্ঞাপন আর লাভের হিসাব করতে গিয়ে সিনেমা এবং টেলিভিশন নির্মাতারা এই চমৎকার সুযোগের ব্যবহারে ভারসাম্য ধরে রাখতে হিমশিম খেয়ে যান।
“তাদের নির্মাণগুলোর জন্য অবশ্যই বাজার থাকা জরুরি। সম্ভাবনা ও লাভের হিসাব সবসময় একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে।”
কিন্তু একজন নারী প্রেসিডেন্ট কেন সেই লাভের হিসাব হুমকির মুখে ফেলে?
যদি সিনেমা অথবা কোনো টিভি সিরিজ অন্য ছকে বানানো যায়, তাহলে এর নির্মাণ বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে কেন পরিবর্তন আনতে পারছে না?
নারী প্রেসিডেন্ট নিয়ে একটি গ্রন্থের সহ-লেখক কেরিন ভাসবি অ্যান্ডারসন কাজ করেন কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে।
তার মতে, অতীতে এ ধরনের চরিত্র আনতে গিয়ে কট্টর রক্ষণশীল দর্শকরা হয়তো সরে গিয়েছিল।
“বিশ্বের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানে হলো পৌরুষত্ব এবং পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতীক, যেখানে ফার্স্ট লেডি পার্শ্বচরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। একজন নারী প্রেসিডেন্ট এসব ধারণাকে ভেঙে দেয়।”
এ কারণে পর্দায় নারী প্রেসিডেন্টকে সাধারণত গুরুত্বের চোখে দেখা হয় না।
‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ’ সিনেমায় প্রেসিডেন্ট চরিত্রটি নিজেকে আগামী দশকের জন্য অনুপ্রেরণাহীন উত্তরসূরি হিসাবে উপস্থাপন করেছে।
এরপরের প্রথম উদাহরণ হচ্ছে ‘প্রজেক্ট মুনবেজ’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার কাহিনী গড়ে ওঠে ১৯৭০ সাল ঘিরে। এরনেস্টিন ব্যারিয়ার প্রেসিডেন্ট চরিত্রে অভিনয় করেন।
ক্ষমতার বাকি পদেও নারী চরিত্র দেখা যায়। যেমন, চন্দ্রমিশনের অধিনায়ক একজন নারী। এই চরিত্রে কাজ করেছেন ডোনা মারটেল।
স্মিথের মতে চন্দ্রমিশনের প্রধান হওয়ার পরও এই চরিত্রটি ‘সহজেই ঘাবড়ে যায়’ এবং ‘পরিস্থিতি বিপজ্জনক হলে পুরুষ সহকর্মী ও প্রেমিকের সাহায্যের উপর নির্ভর হয়ে পড়েন।’
এরপর হলিউডে নারী প্রেসিডেন্ট চরিত্র দেখা যায় সাইন্স ফিকশন সিনেমায়। যেমন, ১৯৮৯ সালের ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ সিনেমার দ্বিতীয় পর্ব, ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা ‘ব্যাটলস্টার গ্যালাকটিকা’ সাই-ফাই টেলিভিশন সিরিজ, ২০১৬ সালের সিনেমা ‘ইন্ডিপেনডেন্স ডে: রিসারজেন্স’, অ্যাপল টিভিতে ২০১৯ থেকে চলা ‘ফর অল ম্যানকাইন্ড’ সিরিজ এবং ২০২১ সালে নেটফ্লিক্সের ‘ডোন্ট লুক আপ’ সিনেমায়।
১৯৮৯ সাল থেকে চলা আমেরিকার জনপ্রিয় ‘দ্য সিম্পসন্স’ কার্টুনের একটি পর্বের নাম ছিল ‘বার্ট টু দ্য ফিউচার’। ২০০০ সালে প্রচার হওয়া ওই এপিসোডে দেখানো হয় সিম্পসন পরিবারের মেয়ে লিসা বড় হয়ে আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হন। ওই পর্বে অবশ্য রসিকতার ছলে এও বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন লিসার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট!
সিনেমা ও সিরিজে বেশিরভাগ সময়ই কোনো নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নারী প্রেসিডেন্টকে জিতে আসতে দেখা যায় না। বরং একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে নারী প্রেসিডেন্ট আর্বিভূত হন।
‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ’ সিনেমাতেও এমন জরুরি পরিস্থিতি এসেছিল।
‘ফিল্ম কমেন্ট’ ম্যাগাজিনে চলচ্চিত্র সমালোচক এবং লেখক ফারান স্মিথ নেহমে বলেছিলেন, “একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া মানে ভোটার না হয়ে গাছের উপর বাস করা একজন সাধক বাদে পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষের মৃত্যু হয়েছে।”
সিনেমা ও নাটকে আরও নমনীয় পরিস্থিতি মানে হলো, পুরুষ প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা পদত্যাগ করলে তবেই এই পদে একজন নারীর দেখা মেলে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ২০০৫ সালে ‘কমান্ডার ইন চিফ’ টেলিভিশন সিরিজে জিনা ডেভিস অভিনয় করেছিলেন ম্যাকেঞ্জি অ্যালেন চরিত্রে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নারী প্রেসিডেন্ট হন।
২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চলা ‘প্রিজন ব্রেক’ সিরিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট হন ক্যারোলাইন রেনল্ডস। এই চরিত্রে কাজ করেছিলেন প্যাট্রিসিয়া ওয়েটটিগ।
২০১২ থেকে ২০১৯ সালের রাজনৈতিক কমেডি সিরিজ ছিল ‘ভিপ’। এতে সেলিনা মায়ার চরিত্রটিও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট হন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে।
আর নেটফ্লিক্সের ‘হাউস অব কার্ডস’ সিরিজে ক্লেয়ার হেইল আন্ডারউড চরিত্রটি ফার্স্ট লেডি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন।
সিনেমা বা সিরিজে নারীরা কেউ ভোটের প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট পদে বসেন না। আবার এসব সিনেমায় প্রেসিডেন্ট হওয়া নারীদেরও এই পদে বসতে উৎসাহী দেখা যায়নি।
“টেলিভিশন ও সিনেমায় শুধুমাত্র সেই নারীই প্রেসিডেন্ট পদে বসার উপযুক্ত হন যিনি আসলে সেখানে থাকতে চান না”, বললেন অ্যা্ন্ডারসন।
“নায়কোচিত নারী প্রেসিডেন্ট মানে পরিশেষে জনসেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়া; যেমন দেখানো হয়েছে টিয়া লিওনি অভিনীত ‘ম্যাডাম সেক্রেটারি’ সিরিজে।”
“অন্যদিকে ‘টোয়েন্টিফোর ফোর’ সিরিজের চেরি জোন্স অভিনীত বা জুলিয়া লুই-ড্রাইফাস অভিনীত ‘ভিপ’ সিরিজে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারী প্রেসিডেন্টের পরিণতি মর্মান্তিক দেখানো হয়।”
“কাল্পনিক হলেও পুরুষ প্রেসিডেন্ট নীতিবান, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন। কিন্তু পর্দায় নারী প্রেসিডেন্টকে বেছে নিতে হবে গ্রহণযোগ্যতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে কোনো একটি।”
পর্দায় নারী প্রেসিডেন্ট দেখানোর আরেকটি কৌশল হলো তাদের সরকার পরিচালনায় মনোযোগী দেখানো হয় না। ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন দ্য আর্থ’ যেমন নারী প্রেসিডেন্টকে বিড়াল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখিয়েছে। অন্যান্য সিনেমায় নারী প্রেসিডেন্টদের স্বামী ও সন্তানের কারণে সরকারে মনোযোগ হারাতে দেখা যায়।
এবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্কে ১৯৮৫ সালে ‘হেইল টু দ্য চিফ’ কমেডি সিরিজ জনপ্রিয় হয়। এতে প্যাটি ডুক অভিনয় করেন জুলিয়া ম্যান্সফিল্ড চরিত্রে। এই সিটকমে নারী প্রেসিডেন্ট জুলিয়া ম্যান্সফিল্ড সবসময় সংসার ও সরকারের দায়িত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকেন। এর ২০ বছর পরে এই সিরিজের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, একজন নারী প্রেসিডেন্ট কাঁধে বিশ্ব আর পিঠে সন্তান বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ’ একশ বছর পার করেছে। এরমধ্যে খুব ধীরে হলেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। একুশ শতকে অনেক ফিকশনে নারী প্রেসিডেন্ট দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক পরিচয় বড় করে দেখানো হচ্ছে না।
২০২১ সালের ‘ডোন্ট লুক আপ’ সিনেমায় মেরিল স্ট্রিপ অভিনয় করে প্রসিডেন্ট জেনি ওরলিয়ান চরিত্রে। ওরলিয়ান একজন ভয়ানক প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি নারী বলেই ভয়ানক এমন ভাবে দেখানো হয়নি।
২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের ‘স্টেট অব অ্যাফেয়ার্স’ সিরিজে অভিনেত্রী অলফ্রে উডার্ড অভিনীত কনস্ট্যান্স পেটন চরিত্রটিকেও কঠিন ও দক্ষ দেখানো হয়েছে।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের হয়ে লড়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন সরে দাঁড়ালে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে ট্রাম্পের বিপরীতে টক্কর দিচ্ছেন ডেমোক্রেট পার্টি থেকে কমলা হ্যারিস।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদে হিলারি ক্লিনটনের প্রার্থী হওয়া এসব চরিত্রের উপর বড় প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে করছেন স্মিথ।
তিনি বলেন, “ ম্যাডাম সেক্রেটারি সিরিজের এলিজাবেথ ম্যাককর্ড চরিত্রটি ক্লিনটনকে নিয়ে হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে এই চরিত্রের গভীরতায় হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ভূমিকা ছিল।
“এই সিরিজ আমার কাছে নানা ভাবে আলাদা মনে হয়েছে। আগে নারী প্রেসিডেন্টকে যেভাবে সিনেমায় বা সিরিজে নির্মাণ করা হতো সেসব ধারণা ভাঙার চেষ্টা ছিল এখানে।”
বাস্তবে রাজনীতিতে যত বেশি নারী দেখা যাবে কল্পকাহিনীতেও তত বেশি নারী রাজনীতিক চরিত্র আসবে বলে মনে করেন স্মিথ। আবার এর উল্টোটাও সত্যি হতে পারে, বলছেন তিনি।
এও সত্যি যে সিনেমা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকবে অনেক দিক দিয়েই।
১৯৬৪ সালের ‘কিসেস ফর মাই প্রেসিডেন্ট’ কমেডি ঘরানার সিনেমায় পলি বার্গেন প্রেসিডেন্ট এবং ফ্রেড ম্যাকমার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করেন। স্বামী চরিত্রেটিকে প্রথম পুরুষ ফার্স্ট লেডি হওয়ার নানা দিক সামাল দিতে হয়।
বিবিসি’র প্রতিবেদন অবলম্বনে