বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বলতে সবার আগে নাম আসে তৈরি পোশাক বা গার্মেন্টস পণ্যের। কখনও কখনও পাট, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া রপ্তানি নিয়েও আলোচনা হয়; শোনা যায় আশা আর হতাশার কথা।
কিন্তু সবাইকে চমকে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে পাট, চামড়া, চিংড়ি, কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল হোম টেক্সটাইল।
সেবার ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল এই খাত থেকে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
সেই আশায় ভর করে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি পড়ে। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আসে ১০৯ কোটি ৫২ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলার। আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে আয় কমে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ; লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আসে ৪৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
সেই নেতিবাচক ধারা এখনও চলছে; কমছেই হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এই খাত থেকে মাত্র ৬৩ কোটি ৬৫ লাখ ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ৩১ শতাংশ।
এই নয় মাসে ৯২ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আয় হয়েছিল ৮৬ কোটি ডলার।
কোভিড মহামারিকালে চীন ও ভারতের বাজার বাংলাদেশে চলে আসায় হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে উল্লম্ফন হয়েছিল বলে বলে মনে করেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা। এখন সেই বাজার ফের দখল করে নিয়েছে দেশ দুটি। সেইসঙ্গে পাকিস্তানের রপ্তানিও বেড়েছে বলে জানান তারা।
হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন রপ্তানি কমে যাওয়ার জন্য। প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে হোম টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা কমেছে। দ্বিতীয়ত, গ্যাস সংকট এবং দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তৃতীয়ত, দেশে সুতার দাম বেড়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের ১২৫টি দেশে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে বড় বাজার।
হোম টেক্সটাইল খাতে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে রপ্তানি করছে ৪৫ থেকে ৫০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নোমান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকসে, হোম টেক্সটাইল লিমিটেড, সাদ মুসা, শাবাব ফেব্রিকস, অলটেক্স, টাওয়েল টেক্স।
ইপিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, কোভিড মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। পরের বছর তা ৭৬ কোটি ডলারে নামলেও পরের দুই বছরে রপ্তানি বাড়ে দ্রুতগতিতে।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ১১৩ কোটি (১.১৩ বিলিয়ন) ডলারে ওঠে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আরও বেড়ে ১৬২ কোটি (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারে উন্নীত হয়, প্রবৃদ্ধি হয় ৪৩ শতাংশ।
দেশের মোট হোম টেক্সটাইল রপ্তানির অর্ধেকেরই বেশি রপ্তানি করে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ জাবের ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং দেশে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের মূল বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সেখানকার ভোক্তারা নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাব রপ্তানিতে পড়েছে।
“আমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা আছে। গ্যাস সংকট আছে। এরমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমরা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (তুলা ও কেমিকেল) আমদানি করতে পারছি না। সেইসঙ্গে এগুলোর দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না।”
১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু হয় জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকসের। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল রপ্তানিতে দেশের সেরা হওয়া। প্রথম রপ্তানি শুরু হয় ২০০০ সালে। সেই বছর ৬৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করি ইউরোপের বাজারে। প্রথম রপ্তানি পণ্য ছিল বিছানার চাদর বা বেডশিট।
জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের বর্তমানে ১৮ থেকে ২০ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ইকিয়া, এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, টার্গেট, কেমার্ট, ক্যারিফোর ইত্যাদি।
পোশাক খাতের মতো সরকারের সুনজর পেলে এই খাত থেকে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন জাবের।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সাবেক চেয়ারম্যান টাওয়েল টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহাদাৎ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গ্যাসের সংকট তো লেগেই আছে। চাহিদা অনুযায়ী কোনও কারখানাই গ্যাস পায় না। এর মধ্যে গ্যাসের দাম ১৫৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
“গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর প্রতি কেজি টাওয়েলের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১ ডলারের মতো। এছাড়া সম্প্রতি সুতার দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এ জন্য ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আর প্রতিযোগিতায় পারছি না।”
তিনি বলেন, “করোনা মহামারির পর চীন, ভারত ও পাকিস্তানের অনেক অর্ডার আমরা পেয়েছিলাম। এখন আর সেগুলো পাচ্ছি না। সে কারণেই আমাদের রপ্তানি কমছে।”
হোম টেক্সটাইল রপ্তানির সম্ভাবনা এখনও রয়েছে দাবি করে শাহাদাৎ বলেন, “যে ভালো সম্ভাবনা আছে, সেটির প্রমাণ আমরা দিয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। সেটি হলে ডলার-সংকটের এই কঠিন সময়ে রপ্তানি আয় বাড়বে।”
হোম টেক্সটাইল কী
হোম টেক্সটাইল বলতে বোঝায় ঘরের অন্দরের শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা বস্ত্রপণ্য। এ কারণে এ ধরনের পণ্যকে হোমটেক্স বা ঘরোয়া টেক্সটাইলও বলা হয়ে থাকে।
বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টেবিল ক্লথ, পর্দা, ফ্লোর ম্যাট, কার্পেট, জিকজাক গালিচা, ফার্নিচারে ব্যবহার করা ফেব্রিকস, তোশক, পাপোষ, খাবার টেবিলের রানার, কৃত্রিম ফুল, নকশি কাঁথা, খেলনা, কম্বলের বিকল্প কমফোর্টার, বাথরুম টাওয়েল, রান্নাঘর ও গৃহসজ্জায় ব্যবহার হয় এমন সব পণ্য এ খাতের আওতাভুক্ত।
এশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা, পাট, শন, রেশম, ভেড়া-ছাগলের পশম, অন্যান্য পশম। এছাড়া সম্প্রতি কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারেও হোম টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন হচ্ছে দেশে।
প্রধান বাজার বড় ব্র্যান্ড
বৈশ্বিক হোম টেক্সটাইলের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা। মোটের ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় দুই মহাদেশের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইলের ৮০ শতাংশ যায় এ দুই বাজারে।
বিশ্বখ্যাত ক্যারফোর, ওয়ালমার্ট, ইকিয়া, আলদি, এইচঅ্যান্ডএম, মরিস ফিলিপস, হ্যামার মতো বড় ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশের হোম টেক্সের বড় ক্রেতা। অন্যান্য খুচরা ক্রেতার সংখ্যাও কম নয় বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি খাতের অন্যান্য পণ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় হোম টেক্সটাইল।
১২ বছরের রপ্তানির চিত্র
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৭৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়ের অঙ্ক ছিল একটু বেশি ৮৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল যথাক্রমে ৮৭ কোটি ৮৬ লাখ, ৭৯ কোটি ৯১ লাখ ও ৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
আগের তিন বছর ২০১২-১৩, ২০১১-১২ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ৭৯ কোটি ১৫ লাখ, ৯০ কোটি ৬০ লাখ এবং ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছিল।