সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর পর হাসপাতালে হামলা হয়েছে। শুধু এবারই নয়, হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর পর হামলার খবর এর আগেও নানা সময়ে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ ধরনের হামলার কারণ কী? কেন মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রিয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় কখনও কখনও এরকম সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সকাল সন্ধ্যা। পড়ুন নিচের শিরোনামে ক্লিক করে।
তথ্যের অভাব
প্রিয়জনের মৃত্যুর পিছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে পরিবারের মনে প্রায়ই খারাপ চিন্তা আসে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তারা চিকিৎসাগত অবহেলা, ভুল চিকিৎসা, এমনকি ইচ্ছাকৃত ক্ষতির সন্দেহ করতে পারে।
রোগীর অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পেতে দেরি হলে বা অসম্পূর্ণ তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট পরিবার বিষয়টিকে হাসপাতালের উদাসীনতা বা কিছু গোপন করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে পারে। ফলে সত্য উন্মোচনের তাড়না থেকে সংশ্লষ্টিরা সহিংস হয় উঠতে পারে।
কেন প্রিয়জন চলে গেলেন- তা না জানার যন্ত্রণা পরিবারের জন্য অসহ্য হয়ে ওঠে। এই অমীমাংসিত বেদনা রূপ নিতে পারে রাগে। তাদের মধ্যে জেগে উঠতে পারে কাউকে জবাবদিহি করার ইচ্ছা।
এই সহিংসতার চক্র ভাঙতে হলে হাসপাতালগুলো পরিবারের সঙ্গে স্বচ্ছ, সময়োচিত ও সহানুভূতিপূর্ণ যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবারকে সঠিক তথ্য দেওয়া, তাদের উদ্বেগের সমাধান করা, সহানুভূতি প্রকাশ করা বিশ্বাস ও বোঝাপড়া বাড়াতে সহায়তা করবে। ফলে সহিংসতার ঝুঁকি কমবে।
চিকিৎসাগত ভুলত্রুটি ও অবহেলা
কোনো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাই নিখুঁত নয়। তা সত্ত্বেও যোগাযোগের অভাবের ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে, বিশেষ করে যখন এগুলো রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়।
রোগ নির্ণয়ে দেরি ও ভুল: রোগীর অবস্থা ঠিক সময়ে বা ঠিকভাবে নির্ণয় করতে না পারলে বিলম্বিত বা অকার্যকর চিকিৎসা হতে পারে,যার ফল হতে পারে রোগীর মৃত্যু। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা মনে করতে পারে যে, সময়মতো রোগ নির্ণয় করা গেলে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যু এড়ানো যেত। এক্ষেত্রে তারা ক্রোধ অনুভব করতে পারে এবং প্রতিশোধ নিতে চাইতে পারে।
অস্ত্রোপচারে ভুল: অস্ত্রোপচারের সময় ভুলের মারাত্মক পরিণাম হতে পারে। যদি পরিবার মনে করে যে অস্ত্রোপচারটি অপ্রয়োজনীয় ছিল বা ঠিকভাবে হয়নি বা ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের যথাযথভাবে জানানো হয়নি; তাহলে তারা মনে করতে পারে যে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যু আসলে এড়ানো যেত। এবং এক্ষেত্রে তারা সহিংস উপায়ে বিচার চাইতে পারে।
ওষুধের ভুল: ওষুধের ভুল ডোজ, ভুল ওষুধ বা দেরিতে ওষুধ দেওয়াও রোগীর ক্ষতি এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। এ ধরনের ভুল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রতি পরিবারের বিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে এবং তাদের ভেতর প্রতিশোধের ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে পারে।
তথ্য ও স্বচ্ছতার অভাব: হাসপাতাল যদি রোগীর অবস্থা, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে পরিবারকে সঠিক ও সময়োচিত তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস ও সন্দেহের পরিবেশ। পরিবার মনে করতে পারে তাদের কাছে তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে। ফলে তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে পারে।
সহানুভূতিহীন যোগাযোগ: শোকাহত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় চিকিৎসাকর্মীরা সহানুভূতি বা সংবেদনশীলতার অভাব দেখালে পরিবারের দুঃখ আরও বাড়তে পারে। কঠিন শব্দ ব্যবহার, উদ্বেগকে গুরুত্ব না দেওয়া, বা পর্যাপ্ত মানসিক সহায়তা না দেওয়া পরিবারকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে এবং ক্ষোভ তৈরি করতে পারে।
ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
কম কর্মী ও অতিরিক্ত চাপ: কর্মী সংকটে থাকা হাসপাতালগুলোতে কর্মীরা অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকতে পারেন। এর ফলে চিকিৎসাগত ত্রুটি ও যোগাযোগের ভুলের সম্ভাবনা বাড়ে। পরিবার এটিকে যত্ন বা মনোযোগের অভাব হিসেবে হিসাবে দেখতে পারে, যা তাদের মধ্যে অন্যায়ের শিকার হওয়ার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে তোলে।
দুর্বল অবকাঠামো ও সংস্থানের ঘাটতি: সীমিত সংস্থান, পুরনো সরঞ্জাম, বা দুর্বল অবকাঠামো চিকিৎসার মান বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে পরিবার মনে করতে পারে যে তাদের প্রিয়জন সম্ভাব্য সেরা চিকিৎসা পায়নি, যার ফলে হাসপাতাল ব্যবস্থার প্রতি তাদের রাগ ও ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতা
প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা গভীর, মর্মান্তিক। আর যারা আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য শোক আরও ভারী হয়ে পড়ে। কিছু দুঃখজনক ক্ষেত্রে, এই মানসিক ঝড় বয়ে যায় হাসপাতাল হামলার রূপে।
মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগ আছে এমন ব্যক্তিরা হারানোর শোকের মুখে হতাশা, আশাহীনতা ও তীব্র উদ্বিগ্নতার দিকে ঝুঁকতে পারেন। এই মানসিক দুর্বলতা তাৎক্ষণিক এবং সম্ভাব্য সহিংস প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
যারা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বা অন্যান্য ধরনের আঘাতের শিকার, তাদের প্রিয়জনের অসুস্থতা ও মৃত্যুর চাপ ও অনিশ্চয়তা ট্রিগার করতে পারে। এটি ফ্ল্যাশব্যাক, আতঙ্কের আক্রমণ এবং উচ্চতর মানসিক প্রতিক্রিয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার ফলে আক্রমণাত্মক আচরণ হতে পারে।
প্রিয়জন হারানোর তীব্র শোক কিছু মানুষের মধ্যে মানসিক অবসাদ, উদ্বিগ্নতা, এমনকি আত্মঘাতী চিন্তাও জাগিয়ে তুলতে পারে। এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শোকের প্রক্রিয়া আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং অযৌক্তিক চিন্তা ও আচরণের দিকে ঢুকিয়ে দিতে পারে।
অনেকের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম, তারা শোকের তীব্র অনুভূতি সামলাতে ব্যর্থ হতে পারেন। ফলে হতাশা,রাগ ও অসহায়ত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এই অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতি তাৎক্ষণিক কাজ করা ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়।
কিছু ক্ষেত্রে মানুষ মদ বা মাদকদ্রব্য দিয়ে শোকের ব্যথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করতে পারে। ফলে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি নষ্ট হয় এবং সহিংস আচরণের সম্ভাবনা বাড়ে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি শোকাহত পরিবারের মানসিক অবস্থা উপেক্ষা করে বা তাদের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে পরিবারের মধ্যে বিরক্তি ও ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। এই অবজ্ঞা তাদের দুঃখকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং অসহায়ত্বের অনুভূতি তৈরি করতে পারে, যা কখনও কখনও সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
উৎস: যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, এজেন্সি ফর হেলথকেয়ার রিসার্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অন মেন্টাল ইলনেসের বিভিন্ন গবেষণা, চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাপত্রের অনলাইন ডেটাবেইজ পাবমেড, নিউ ইয়র্ক টাইমস, এবিসি নিউজ, রয়টার্স ইত্যাদি।
এই আদ্যোপান্ত তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বার্ড-এর সহায়তা নেওয়া হয়েছে।