ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭০ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে রোগী এখন ৫ শতাধিক। মেঝে এবং বারান্দায় রোগীর চাপের কারণে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলছেন, “অতিরিক্ত গরমে শ্বাসকষ্ট, সর্দি, ঠাণ্ডা এবং নিউমোনিয়ায় সবচেয়ে বেশি শিশুরা আক্তান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ২ শতাধিক রোগী আসছে।”
ফরিদপুর অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর অবস্থাও একই রকম। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মো. আব্দুল হান্নান রোগী বেড়ে যাওয়ার জন্য গরমকেই দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, “অতিমাত্রায় গরমের কারণে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। হাসপাতালের বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরেও চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে।”
দেশজুড়ে এখন তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় হাজারের রোগী যাচ্ছেন রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে। ১০০ শয্যার হাসপাতালে আড়াইশ রোগী ভর্তি আছে।
গরম যেখানে চরম, সেই চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। গত সোমবার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুরা করিডোর এবং সিঁড়ির নিচে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। কারণ ডায়রিয়া আক্রান্তদের জন্য ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে মাত্র ১২টি শয্যা বরাদ্দ। যেখানে রোগী ৭১ জন।
রোগীর ভিড় নিয়ে পাবনার জেলা সিভিল সার্জন ডা. শহীদুল্লাহ দেওয়ান জানালেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ৫০টি শয্যা থাকলেও ভর্তি রোগী এখন ৬০ থেকে ৭০ জন করে।
রাজশাহী জেলা ডেপুটি সিভিল সার্জন মাহবুবা খাতুন জানান, এই গরমে জেলার নয় উপজেলায় প্রতিদিন গড়ে ৭০০ করে রোগী ভর্তি হচ্ছে।
মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় একটি শয্যার বিপরীতে রয়েছে তিনজন করে। মাদারীপুর সিভিল সার্জন মুনীর আহমেদ খানও বলেন, গরম বেশি হওয়ায় ডায়ারিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
খুলনা বিভাগসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগী এখন প্রায় দেড় হাজার।
খুলনা শিশু হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে আসা নগরীর রূপসা এলাকার আরাফাত হোসেন অনিক জানালেন, প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে বমি, খিঁচুনিও হচ্ছে তার মেয়ের।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা একটি ভ্রান্ত ধারণার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “অনেকেই মনে করেন, শিশুরা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয় না। কিন্তু এটা ঠিক নয়। বরং হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যু অনেক বেশি।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কারণ এই বয়সের শিশুদের ‘থার্মো রেগুলেশন’ খুব কম এবং এ কারণেই তারা ‘ভালনারেবল’।”
অধ্যাপক আবিদ বলেন, হিটক্রাম্প, হিট এক্সরসন এবং হিটস্ট্রোক-তিনটিতেই শিশুরা আক্রান্ত হতে পারে। আবার গর্ভবতী নারীরা যদি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের ‘প্রিম্যাচিউর্ড গর্ভপাত’ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কখনও কখনও ‘অ্যাবরশন’ পর্যন্ত হয়ে যায়।
বৈশাখের দাবদাহের মধ্যে এমন অবস্থা গোটা দেশজুড়ে। আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল, বগুড়া, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অন্য অঞ্চলগুলোর ওপরও মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে।
এবার বৈশাখের শুরু থেকেই প্রায় বৃষ্টিহীন দেশ; ফলে গরমে নাভিঃশ্বাস উঠেছে জনজীবনে। তাপপ্রবাহের কারণ আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্কতা চলছে। এর মধ্যে হিট স্ট্রোকের ঘটনাও ঘটছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘হিট রিলেটেড ইলনেস’ নিয়ে বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অধিদপ্তর এ সংক্রান্ত গাইডলাইন তৈরি করেছে, হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, প্রতি বছরই যখন গরম বাড়ছে, তাহলে কেন এ সময়কে মাথায় রেখে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হলো না? হাসপাতালগুলোকে কেন প্রস্তুত করা হলো না? স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থায় ব্যবস্থাপনা কেন জরুরি হবে না?
‘ঘাড়ে বিপদ এলে টনক নড়ে’
আবহাওয়া অধিদপ্তর হিট অ্যালার্ট জারি করলেও চলমান তাপপ্রবাহের মাত্র বিবেচনায় এই পরিস্থিতিতে জরুরি জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার প্রয়োজন দেখছেন ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক এবং সাউথ এশিয়ান মেটিওরোলোজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (সামা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন কুমার দাশ।
তা যেমন হয়নি, তেমনি গরমের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে সরকারের প্রস্তুতির অভাব দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের প্রস্তুতিতে দেরির জন্য নেতৃত্ব এবং সমন্বিত উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের সবসময়ই শেষ মুহূর্তে কিছু একটা করতে হবে, আপদ যখন ঘাড়ে আসে, তখন আমাদের টনক নড়ে।
“যেখানে সবাই জানি গরম দিনকে দিন বাড়বে, অসহনীয় হয়ে উঠবে এ পরিস্থিতি। অথচ গরমের সময়েই এ অবস্থা নিয়ে আমরা ‘ইমার্জেন্সি প্রিপায়ার্ডনেস’ তৈরি করতে পারিনি। যতই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অথবা আমরা বাইরে থেকে বলি না কেন, সরকারের কানে এসব পৌঁছায় না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদও বলেন, কোনও দূরবর্তী পরিকল্পনা নেওয়ার কথা স্বাস্থ্য বিভাগ ভাবে না, ভাবতেও পারে না।
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতি খরা হবে, অতি বন্যা হবে, বছর বছর গরম আরও বাড়াবে-এটা না বোঝার মতো কিছু না। সবাই যদি এটা জেনে থাকে, তাহলে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ কেন জানবে না- এটাই প্রশ্ন।
“এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের এখনই একটি স্ট্যান্ডিং অর্ডার দরকার। যেখানে পরিবেশ, জলবায়ুসহ এরকম জরুরি অবস্থায় যখন যেটা প্রয়োজন হয়, তখন সেটা করা হবে। নতুন করে কিছুর জন্য অর্ডার দিতে হবে না, সময়ক্ষেপণ হবে না।”
এখন হাসপাতালে শয্যা উপচেপড়া ভিড়ের দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “বারান্দায় থাকতে হচ্ছে রোগীদের, সিলিং ফ্যান পর্যন্ত নেই। এমনও হয়েছে, হাসপাতালে থেকে রোগী তো বটেই, স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এভাবে চলতে পারে না।”
এই মুহূর্তে একটি ‘সমন্বিত কর্মকৌশল’ প্রণয়নে জোর দিয়ে অধ্যাপক বে-নজির বলেন, “দরকার ছিল মার্চ নাগাদ এনিয়ে করণীয় ঠিক করা, হাসপাতালগুলোতে ওষুধ পর্যাপ্ত রাখা, ওরস্যালাইনের বাজার ঠিক রাখা, শ্রমজীবী মানুষদের এ নিয়ে সচেতন করা, এই সময়ে তাদের পেশার বিকল্প হিসেবে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। নয়ত বছর বছর মানুষের ভোগান্তি বাড়বে বৈ কমবে না।”
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ না হলে শহরের বড় হাসপাতালগুলোতে যেমন রোগীরা ভোগান্তির শিকার হবে, তেমনি সেখানে মানসম্মত চিকিৎসাও পাওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থায় চিকিৎসা ব্যবস্থাটা কেন জরুরি হবে না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “কারণ আমাদের চিন্তাধারাতেই গলদ, বড় বড় অট্টালিকা আর যন্ত্রপাতি কেনায় ব্যস্ত সবাই। ডেঙ্গুর সময় রোগীরা বেড পায় না, মেঝেতে থাকতে হয়, করোনার আগে দেশের আইসিইউসহ অন্যান্য চিকিৎসা যন্ত্রের কী অবস্থা ছিল, সেটাতো করোনাই দেখিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে এখনও শিক্ষা নিইনি, যদিও সবাই ভেবেছিল করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে।”
বড় হাসপাতালে ভিড় দেখিয়ে তিনি বলেন, “দেশভর্তি মানুষ মেডিকেল কলেজগুলোতেই যদি আসবে, তাহলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো গেল কোথায়?
“স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ হলে মানুষ আগে তার কাছের ( গ্রামের) স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে যাবে, এরপর যাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, এরপর জেলা সদর হাসপাতালে এবং যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আসবে, তখন তিনি আসবেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।”
মন্ত্রণালয় এখনও খসড়ায়
গরম চরমে ওঠার পর হিট স্ট্রোকের রোগী বাড়ার কথা ভাবনায় রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবে ‘হিট রিলেটেড ইলনেস’ এর খসড়া তৈরির কাজ চালাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “তাপমাত্রার যে অবস্থা, তাতে করে হিটস্ট্রোকের রোগী বাড়তে পারে। সেটা মাথায় রেখেই অধিদপ্তর এ সংক্রান্ত গাইডলাইন তৈরি করছে, বর্তমানে তার খসড়া তৈরির কাজ চলছে।”
এই নীতিমালার আওতায় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু, করোনার রোগীদের চিকিৎসার মতো হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ হবে সেখানে।”
আবু জামিল বলেন, “সামনে গরম বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা যদি এখনও সমন্বিত পদক্ষেপ নিই, এই গরমকে প্রায়োরিটি দিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়, সেটাও মন্দের ভালো হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার মোকাবেলা জরুরি ব্যবস্থাপনায় করতে হবে।”
গরমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সমন্বিত কর্মকৌশল নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, “আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছি মাত্র তিন মাস। আগে থেকে কেন পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি, এ সম্পর্কে তো আমি বলতে পারব না, যারা আগে মন্ত্রী ছিলেন, তারা বলতে পারবে।”
আপনি কোনও উদ্যোগ নেবেন কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে আপাতত উদ্যোগ নিয়েছি। দেখা যাক কী করা যায়।”
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, বগুড়া, খুলনার আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা]