গত বুধবার লোহিত সাগরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতি মিলিশিয়াদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনজন নিহত এবং অন্তত ৬ জন আহত হয়। এই প্রথম কোনও জাহাজে হুতিদের হামলায় নিহতের ঘটনা ঘটল। এতে ফিলিস্তিনের গাজার যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে গত নভেম্বর থেকে হুতিরা লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলাকারী ইসরায়েল ও ইউরোপ-আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে হামলা শুরু করে।
তবে লোহিত সাগরের এডেন উপসাগরে বুধবার হুতিরা ট্রু কনফিডেন্স নামের যে জাহাজটিতে হামলা চালায় সেটি ছিলো বার্বাডোজের পতাকাবাহী ও লাইবেরিয়ার মালিকানাধীন একটি বড় মালবাহী জাহাজ। জাহাজটির পরিচালনার দায়িত্বে আছে থার্ড জানুয়ারি ম্যারিটাইম লিমিটেড নামের গ্রিসের একটি কোম্পানি।
জাহাজটি চীন থেকে স্টিল পণ্য ও ট্রাক নিয়ে লোহিত সাগরীয় দুই বন্দর সৌদি আরবের জেদ্দা ও জর্ডানের আকাবার দিকে যাচ্ছিল।
মেরিটাইম ডেটা সরবরাহকারী লয়েডস লিস্ট ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, ২৪ ফেব্রুয়ারির আগে ট্রু কনফিডেন্সের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওকট্রি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের সম্পর্ক ছিল।
তবে ওকট্রি জানিয়েছে, জাহাজটির সঙ্গে তাদের আর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু জাহাজটির মালিকানার পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য বেশ কয়েকটি শিপিং ডেটাবেজে আপডেট করা হয়নি। আর এজন্যই হয়তো হুতিরা জাহাজটিকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে।
বুধবার রাতে হুতির সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারিয়া বলেছেন, “ইয়েমেনি নৌ বাহিনীর সতর্কবার্তা প্রত্যাখ্যান করার পরে তাদের বাহিনী আমেরিকান জাহাজ ট্রু কনফিডেন্সে হামলা করেছে।”
ইয়াহিয়া সারি বলেন, “ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করার জন্য তাদের ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে অবিচল রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হলে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের উপর থেকে অবরোধ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত লোহিত ও আরব সাগরে তাদের অভিযানও বন্ধ হবে না।”
যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার কড়া জবাব দেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছে। সেই জবাব কেমন হবে সেটা স্পষ্ট করে না বললেও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই হুতিদের লক্ষ্য করে একের পর এক বিমান হামলা শুরু করেছে।
তবে এই হামলার একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক, মানবিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে। এটি ইয়েমেনের গত কয়েক বছরব্যাপী যুদ্ধকে আবারও সামনে নিয়ে আসছে, যা গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের দামামায় ঢাকা পড়েছিলো। এদিকে গাজার যুদ্ধ রমজান মাসেও গড়ানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক ক্ষোভও আরও বাড়বে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার ৮০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭২ হাজার ১৯৮ জন আহত হয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের এক ভয়াবহ হামলার জবাবে এই যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছিলো।
লোহিত সাগর সংকট বড় হচ্ছে
প্রথম দিকে হুতিরা বলেছিল, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্যই তারা লোহিত সাগরে হামলা শুরু করেছে। কিন্তু ইসরায়েল ও ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলো এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর এড়িয়ে চলা শুরু করলে তারা গাজা যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন জাহাজগুলোতেও হামলা শুরু করে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সহ মিত্রদের জোটবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ নিজেদের ওপর হুতিদের যেকোনও হামলাকেই প্রতিহত করছে। তাদের সঙ্গে না পেরে হুতিরা এখন বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এসব জাহাজে একমাত্র সুরক্ষা হিসেবে থাকে কিছু সশস্ত্র প্রহরী, কাঁটাতারের বেড়া ও জল কামান, যেটি জলদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু জাহাজ-বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর জন্য নয়।
বুধবারের হামলা এমনকি গাজা যুদ্ধে জড়িত নয় এমন লোকদের জন্যও বিপদ নির্দেশ করে। ট্রু কনফিডেন্সে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দুজন ফিলিপিনো ও একজন ভিয়েতনামি নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ফাম থু হ্যাং বৃহস্পতিবার বলেছেন, “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক রুটে নিরাপত্তা ও নৌ চলাচলের স্বাধীনতার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে অবিলম্বে সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
তবে হুতিরা এই প্রাণহানির দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মিত্রদের ঘাড়েই চাপাচ্ছে। হুথি মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুস সালাম বৃহস্পতিবার অনলাইনে লিখেছেন, “যা কিছু ঘটে তার জন্য আমরা আমেরিকাকে দায়ী করি।” হুতিদের যুক্তি ইসরায়েল গাজায় হামলা না চালালে তারাও লোহিত সাগরে কোনও জাহাজে হামলা চালাতো না।
এর আগে এডেন উপসাগরে হুতি বিদ্রোহীদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার দুই সপ্তাহ পর গত শনিবার রুবিমার নামের ব্রিটিশ মালিকানাধীন পণ্যবাহী জাহাজটি ডুবে গেছে। জাহাজটিতে ২১ হাজার মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সার ছিলো, যা লোহিত সাগরে পরিবেশগত ঝুঁকিও তৈরি করছে।
ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতিরা ২০১৪ সাল থেকে দেশটির রাজধানী সানাসহ দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও হুতিদের দমনে ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইয়েমেনে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু হুতিদের হটাতে না পেরে তারা সরে আসে।
ত্রাণ সহায়তা ও অর্থনীতির ওপরও প্রভাব
হুতিদের হামলা থেকে এমনকি ত্রাণবাহী জাহাজও রেহাই পায়নি। হুতিরা তাদের দখলকৃত অঞ্চলের জন্য পাঠানো ত্রাণ বহনকারী একটি জাহাজেও হামলা করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঘটে এই হামলার ঘটনা।
গ্রীসের পতাকাধারী ও যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন সী চ্যাম্পিয়ন নামের মালবাহী জাহাজটি আর্জেন্টিনা থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে এডেন বন্দরেই যাচ্ছিল। সেখান থেকে ওই ত্রাণ সাহয়তা হুতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হোদেইদাতে যেত। কিন্তু তার আগেই তাদের হামলার শিকার হয় জাহাজটি।
যুদ্ধের ফলে গাজায় যেমন দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে একইভাবে আরব বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ ইয়েমেনেও তীব্র খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সতর্ক করেছে, “লোহিত সাগর সঙ্কট বাড়তে থাকায় ২০২৪ সালে ইয়েমেনের খাদ্য সংকট আরও তীব্র আকার ধারন করবে এবং দেশটিতে চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকটও চরমে উঠবে।”
অন্যদিকে পূর্ব আফ্রিকাকেও গ্রাস করছে এই সংঘাত। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম তথা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) মঙ্গলবার সোমালিয়ায় তাদের কার্যক্রমের বিষয়ে সতর্কতা জারি করে বলেছে, লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলে বাধা তাদের মানবিক সহায়তার নিয়মিত প্রবাহ বজায় রাখার সক্ষমতাকেও বাধাগ্রস্ত করছে। হুতিদের হামলার কারণে ত্রাণ পরিবহনে খরচ বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য উদ্বেগের কারণে তারা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সুদানের পোর্ট সুদানে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতেও হুতিদের হামলার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হুতিদের হামলায় ইসরায়েলের অর্থনীতি তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মিশর রেহাই পায়নি। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান মতে, লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্তকারী সুয়েজ খালে যান চলাচল প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এই খাল দিয়ে চলাচল করা এশিয়া-ইউরোপের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে থেকে মিশরের আয়ের সিংহভাগ আসে।
এই আয়ের ওপর ভিত্তি করেই মিশর আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার তহবিলের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৮ বিলিয়ন ডলার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু নতুন করে কোনও অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে মিশরও আরব বসন্তের মাত্র ১৫ বছর পরই ফের অস্থির হয়ে উঠতে পারে।
বিমান হামলার উল্টো প্রতিক্রিয়া হতে পারে
যুক্তরাষ্ট্র গত জানুয়ারিতে হুতিদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে। এরপর থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা ১০০টিরও বেশি হুতি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। কিন্তু তাতেও হুতিদের হামলার সক্ষমতা কমেনি।
সৌদি আরবও হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ করেও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হুতিদের দমাতে পারেনি। তাই তারা সেখান থেকে সরে আসে এবং হুতিদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির চেষ্টা করছে।
২০২০ সালের শেষদিকে ক্ষমতায় আসার পর ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। এই যুদ্ধের জন্য তিনি সৌদি আরবের কড়া সমালোচনাও করেন। এতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মনোক্ষুণ্ণ হয়। ফলে এবার হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অভিযানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যোগ দেয়নি। এমনকি সৌদি আরব হুতিদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য গত বছর ইরানের সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতায়ও পৌঁছে। যদিও সেই শান্তি চুক্তি এখনও হয়নি।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করাই ইরান সমর্থিত হুতিদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের জায়েদি শিয়া গোষ্ঠী ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইয়েমেনে ১০০০ বছর ধরে রাজত্ব চালায়। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের স্লোগান হলো: “আল্লাহ মহান; যুক্তরাষ্ট্র নিপাত যাক; ইসরায়েল নিপাত যাক; ইহুদীদের প্রতি অভিশাপ; ইসলামের বিজয় হোক।”
দুই চরম শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে হুতিরা ইয়েমেনে তাদের সমর্থন বাড়ানোর পাশপাশি গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ক্ষুব্ধ আরব বিশ্বেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। গাজা যুদ্ধ যদি রমজান মাসেও গড়ায়, যা ইসলামে শান্তি ও আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে স্বীকৃত, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তথ্যসূত্র: এপি, রয়টার্স, বিবিসি