Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

হলিউড-বলিউড সিনেমাকে বদলে দিচ্ছে এআই, শিল্পের ক্ষতি হবে নাকি লাভ?

movie-ai-0
[publishpress_authors_box]

চার্লি চ্যাপলিনের যুগের সেই নির্বাক সিনেমা থেকে আজকের চমকপ্রদ ভিএফএক্স নির্ভর ব্লকবাস্টার সিনেমা- চলচ্চিত্র শিল্প এসেছে অনেক দূর। কিন্তু এখন যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা নিছক ক্যামেরা-ক্রেন বা প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রত্যক্ষভাবেই প্রভাব ফেলেছে চলচ্চিত্র শিল্পের শ্রমঘনিষ্ঠ এবং শৈল্পিক খাতগুলোতেও। আর এই দিন বদলের হাওয়া পশ্চিমের হলিউডে যেমন লেগেছে, প্রাচ্যের বলিউডে লাগতে শুরু করেছে ঠিক একইরকমভাবে।

গত মার্চের শেষে লস অ্যাঞ্জেলসের একটি সাউন্ডস্টেজে একটি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক অভিজাত পার্টি আয়োজন করা হয়েছিল। ওই মঞ্চেই একসময় নির্বাক চলচ্চিত্রের তারকা চার্লি চ্যাপলিন এবং মাবেল নরমান্ড কাজ করতেন। ওই অনুষ্ঠানে নির্মাতা, অভিনেতা, প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা এআই জেনারেটেড ভিডিওগুলো নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। এই পার্টির আয়োজক ছিলেন মুনভ্যালির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রিন মুসার। মুনভ্যালির তৈরি ‘মারে’ নামক টুলটি নির্মাতাদের সম্মতির ভিত্তিতে ফুটেজ থেকে এআই ব্যবহার করে ভিডিও তৈরি করে। ব্রিন মুসার ওই পার্টিতে দাাবি করেন, “এআই এখন অনিবার্য।” কিন্তু এই ‘অনিবার্যতা’র অর্থ কী, তা নিয়েই চলছে বিতর্ক।

মাত্র দুই বছর আগে, ২০২৩ সালের মে মাসে, হলিউডে লেখক এবং অভিনেতারা ধর্মঘটে নেমেছিলেন এআই-এর প্রভাব থেকে তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার দাবিতে। সেই ধর্মঘট প্রায় কয়েক মাস স্থায়ী হয় এবং পুরো ইন্ডাস্ট্রি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। মূল অভিযোগ ছিল—প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো অনুমতি ছাড়াই কনটেন্ট ব্যবহার করে এআই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যা সৃষ্টিশীল পেশাজীবীদের হুমকির মুখে ফেলছে।

এই সমস্যা কেবল লেখকদের নয়। ব্যাকগ্রাউন্ড অভিনেতা, ভিজ্যুয়াল এফেক্ট আর্টিস্ট, এমনকি ভয়েস ওভার শিল্পীরাও আতঙ্কে রয়েছে। জনপ্রিয় এআই টুল চ্যাটজিপিটি- এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ হারানোর তালিকায় সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন ব্যাকগ্রাউন্ড অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, যেখানে চরিত্রের মুখ, কণ্ঠস্বর এমনকি পুরো পারফরম্যান্স অনুকরণ করতে পারে এআই। অন্যদিকে, শীর্ষ তারকা ও খ্যাতনামা পরিচালকেরা আপাতত নিরাপদ। তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু ও ‘তারকা শক্তি’ এখনো অপ্রতিরোধ্য।

এই প্রেক্ষাপটে ওই বছরেরই মে মাসে ৪০০-এর বেশি হলিউড তারকা একটি খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এআই অ্যাকশন প্ল্যানের সমালোচনা করেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “আমেরিকার বিশ্বজয়ী এআই নেতৃত্ব যেন আমাদের সৃজনশীল শিল্পকে খুইয়ে ফেলার মূল্য দিয়ে গুণতে না হয়।” স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন বেন স্টিলার, স্যার পল ম্যাককার্টনি, কেট ব্ল্যানচেট, লিলি ওয়াচোস্কি—যিনি ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ বানিয়েছিলেন।

আরও আশঙ্কাজনক হলো, গুগল এবং ওপেনএআই মার্কিন কপিরাইট আইনে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে- যাতে জনপ্রিয় সিনেমা ও চরিত্রকে এআই ভিডিও দিয়ে উপস্থাপন করলে ‘ন্যায্য ব্যবহার’ হয়। অর্থাৎ কপিরাইট ভঙ্গ না হয়। এর মানে দাঁড়ায়, আসল নির্মাতার অনুমতি ছাড়াই ভবিষ্যতে হয়তো ‘মোয়ানা’ বা ‘ম্যাট্রিক্স’ এর মতো চরিত্রগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রি-ক্রিয়েট করার সুযোগ তৈরি করা ।

২০২৩ সালেরই জুলাই মাসে, ডিজনির সামনে এক বিক্ষোভে কণ্ঠশিল্পীরা প্রতিবাদ জানান যে, ভিডিও গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনানুমতিতে তাদের কণ্ঠস্বর এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। অভিনেতা ডিডব্লিউ ম্যাককান বলেছিলেন, “মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে আসে অভিনয়ের আবেগ—যা কেবল মানুষই দিতে পারে, এআই নয়।”

তবে এআই যে ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘এমিলিয়া পেরেজ’ এবং ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’—অস্কারে মনোনীত এই দুই সিনেমায় এআই ব্যবহার করা হয় কণ্ঠস্বর উন্নয়নে এবং উচ্চারণ টিউন করতে। চলচ্চিত্রে টম হ্যাঙ্কস এবং হ্যারিসন ফোর্ডের বয়সও এআই দিয়ে কমানো হয়েছে।

বলিউডেও শুরু হয়েছে এআই বিপ্লব। ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প যেখানে বাজেট সীমাবদ্ধতায় ভুগছে, সেখানে এই হতে পারে যুগান্তকারী সমাধান। ভারতে নাইন্টিওয়ান ফিল্ম স্টুডিও’-র সিইও নবীন চন্দ্র বলেন, “আমার কাছে ‘অমর চিত্র কথা’র (ভারতীয় ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তি নিয়ে জনপ্রিয় কমিক সিরিজ) সম্পূর্ণ সংগ্রহ রয়েছে। এআই তা নতুন প্রজন্মের জন্য চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলতে পারবে।”

তিনি যোগ করেন, “আমরা আমাদের গল্পের মাত্র ৫ শতাংশ বলেছি। এআই এর সাহায্যে আমাদের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারকে বর্ণনামূলক সিনেমায় রূপান্তর করা যাবে।”

তবে ভারতের ক্ষেত্রেও আছে একই প্রশ্ন—এই প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে কি? স্টুডিও ব্ল-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা দীপঙ্কর মুখার্জির প্রশ্ন হচ্ছে, “এআই-উৎপাদিত পারফরম্যান্সের অধিকার কার হবে? অতীতের তারকার সাদৃশ্য যদি নতুন সিনেমায় ব্যবহৃত হয়, তবে মালিকানা কার?”

গভীর আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন গ্যালারি ফাইভ- এর সিইও রাহুল রেগুলাপতি, । তিনি বলেন, “এআই এখনো আমাদের আঞ্চলিক অভিব্যক্তি, হাবভাব, সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা ঠিকভাবে ধরতে পারে না। সেজন্য আমাদের ভারতীয় ডেটা দিয়ে এআই-কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।”

গত ৬ মাসে গ্যালারি ফাইভ- এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যাার ব্যবহার করে প্রায় ১০,০০০ হাইপার রিয়েলিস্টিক ছবি ও ভিডিও তৈরি করেছে। এগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে ওয়েবসাইট, ওটিটি, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বাঁচছে, এবং ব্র্যান্ডগুলো ব্র্যান্ডগুলো এখন ব্যাপক পরিসরে এবং আরও কার্যকরভাবে তাদের গল্পগুলো দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে।

তবে রেগুলাপতি সতর্ক করে বলেন, “আসল ঝুঁকি এআই দ্বারা আমাদের প্রতিস্থাপন করার মধ্যে নেই। বরং আমরা যদি আমাদের নিজস্ব শৈলীতে এআই ব্যবহার না করে পশ্চিমা অনুকরণে আটকে থাকি, তখনই আমাদের ক্ষতি।”

অনন্ত প্রোডাকশনের প্রতিষ্ঠাতা অনীশ সুরানা বলেন, “এআই এখনকার প্রি-ভিজুয়ালাইজেশন, কনসেপ্ট প্রোটোটাইপ, এমনকি পিরিয়ড সিনেমার জন্য গ্র্যান্ড ভিজ্যুয়াল তৈরিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।” তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এটা চাকরি হারানোর কারণ হতে পারে—বিশেষ করে জুনিয়র ভিএফএক্স আর্টিস্ট ও টেকনিশিয়ানদের জন্য।”

তবুও এাই যদি সহায়ক হাতিয়ার হয়, তবে তা ছোট নির্মাতাদের জন্য গেম চেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে।

“মালয়ালম বা বাংলা সিনেমা, যেগুলোর বাজেট সীমিত, সেগুলোও AI-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের দৃশ্য তৈরি করতে পারবে,” বলেন সুরানা।

এই প্রযুক্তি শুধু বড় বাজেটের নির্মাতাদের জন্য নয়—এটি স্বাধীন নির্মাতাদের জন্যও শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, যদি তারা তা নৈতিকভাবে ব্যবহার করেন।

হলিউড থেকে বলিউড—এআই এখন এমন এক যুগের সূচনা করেছে, যেখানে সিনেমা শুধু ক্যামেরা ও অভিনেতার নয়, বরং কোড ও অ্যালগরিদমের মেলবন্ধনে তৈরি হবে। প্রশ্ন হলো—এই কোডটা কার হাতে থাকবে? এআই কি শিল্পীর হাতিয়ার হবে, নাকি শিল্পীই হয়ে যাবে এআই এর দাস?

একদিকে প্রযুক্তি খুলে দিচ্ছে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার জানালা—নতুন বিশ্ব, কল্পনার রাজ্য, কম বাজেটে ব্লকবাস্টার প্রজেক্ট। অন্যদিকে, প্রশ্ন জাগছে—এই গল্পগুলো কারা বলছে, এবং তারা কীভাবে বলছে?

চরিত্রের মুখ, কণ্ঠ, এমনকি আবেগ যদি এআই অনুকরণ করে, তবে মানুষের আসল গল্প কোথায় রইল? সিনেমা কি হারাবে তার প্রাণ? নাকি এআই হবে সেই সহকারী, যে চলচ্চিত্র নির্মাতাকে এনে দেবে সীমাহীন কল্পনার পরিসর?

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত