Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

এত ব্যাটারি রিকশা কারা বানাচ্ছে, কীভাবে বানাচ্ছে

নগদ টাকার পাশাপাশি কিস্তিতেও কেনা যায় অটোরিকশা। কিস্তি হতে পারে দৈনিক ও মাসিক। তবে কিস্তিতে কিনলে ৭৫-৮০ হাজার টাকার অটোরিকশা নিতে দিতে হয় ৯০-৯৫ হাজার টাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
নগদ টাকার পাশাপাশি কিস্তিতেও কেনা যায় অটোরিকশা। কিস্তি হতে পারে দৈনিক ও মাসিক। তবে কিস্তিতে কিনলে ৭৫-৮০ হাজার টাকার অটোরিকশা নিতে দিতে হয় ৯০-৯৫ হাজার টাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

মো. রুবেল হোসেন, বয়স তার ৫০ বছর, এর ৩০ বছরেরও বেশি ব্যয় করেছেন প্যাডেল রিকশা বানিয়ে। এই কাজে সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবনের ৩ দশক পেরিয়ে গত মে মাসে নিজের পরিচয় বদলে ফেলেছেন তিনি; বনে গেছেন ব্যাটারি রিকশার মেকানিক।

পরিচয় বদলের কারণ কী- প্রশ্নে রুবেল বললেন, “এমনিতেই প্যাডেল রিকশার সংখ্যা কমতেছে। আমারও কাজ কমতেছিল। এর মধ্যে গত মে মাসে শেখ হাসিনা ঢাকা শহরে ব্যাটারির রিকশা চালু রাখতে বলেন। এরপরই অটোরিকশা বানানোর ধুম পড়ে যায়।

“অনেকে বিভিন্ন দোকানে মাস খানেক আগে সিরিয়াল দিয়েও অটোরিকশা পাচ্ছিলেন না। সেই সময় পরিচিত রিকশাচালকদের অনুরোধে তাদের জন্য অটোরিকশা বানানো শুরু করি। এরপর আরও কাজের অর্ডার পাওয়ায় এখন শুধু অটোই বানাচ্ছি।”

ঢাকার মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার চাঁদের মাঠের পাশে সড়কে বসেই ব্যাটারি রিকশা তৈরি করেন রুবেল। আগে এখানে বসেই প্যাডেল রিকশা মেরামত করতেন তিনি।

মোহাম্মদপুরই শুধু নয়, এখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাটারি রিকশা তৈরির হিড়িক পড়েছে; যদিও এই যান্ত্রিক যান তৈরিতে বিশেষজ্ঞদের কারও কোনও মতামতের তোয়াক্কা কেউ করছে না। অননুমোদিত এই যানের বিষয়ে কোনও নীতিমালাও নেই সরকারের।

রুবেলের মতো মেকানিক হিসাবে পরিচিতরা যার যার মতো করেই তৈরি করে যাচ্ছেন এই যান। ফলে নানা নকশার, নানা ধরনের ব্যাটারি রিকশায় ছেয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ গোটা দেশ।

বুধবার সকালে যখন রুবেলের সঙ্গে কথা হয়, তখন কাজের চাপে দম ফেলারও ফুসরত ছিল না তার। গত মে মাস থেকেই এই অবস্থা বলে জানান তিনি।

অবৈধ হলেও ব্যাটারি রিকশার চলাচল থেমে নেই। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

মাঝে অবশ্য কিছুটা ছেদ ঘটেছিল আদালতের এক আদেশে। অননুমোদিত এই যান তিন দিনের মধ্যে ঢাকা থেকে তুলে নিতে গত ১৯ নভেম্বর সেই আদেশ এসেছিল। তার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামে চালকরা। তাদের অবরোধে টানা কয়েকদিন ঢাকার সড়ক অচল হয়ে ছিল। তারপর ২৫ নভেম্বর আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশে স্থিতাবস্থা দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

১৯ নভেম্বর হাই কোর্টের আদেশের পর কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল রুবেলেও। আগের অর্ডারগুলো বাতিল হয়ে যায় বলে জানান তিনি। তবে ২৫ নভেম্বর আপিল বিভাগের আদেশের পর আবার ব্যস্ততা বেড়েছে তার।

তিনি বলেন, “হাই কোর্ট অটো বন্ধ করার পর তো কয়েকদিন বসেই ছিলাম। যারা অটো বানানোর অর্ডার দিছিল, তারাও ভয়ে ক্যান্সেল করে দিছিল। কিন্তু সোমবার থেকে আবারও কাজের চাপ শুরু হইছে।”

রুবেলরা যেভাবে বানান এই রিকশা

দেশে বহু কাল ধরে প্রচলিত প্যাডেল রিকশার জায়গায় ব্যাটারি রিকশা আসা শুরু হয়েছে দশককাল ধরে। প্রথমে চীন থেকে আমদানি হলেও এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। এই যান বিদ্যুতে চলে বলে এর অনুমোদন দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা বরাবরই দেখা গিয়েছিল।

কিন্তু তার মধ্যেই ব্যাটারি রিকশার বাড়-বাড়ন্ত দেখেও না দেখার ভান করে গেছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তো একে ‘বাংলার টেসলা’ বলে প্রশংসায়ও ভাসিয়েছিলেন।

রুবেলের মতো মেকানিকরা এখন এই যান তৈরি করলেও যন্ত্রাংশগুলো তারা কিনে আনেন, তাদের কাজ শুধু সংযোজন করা।

রুবেল বলেন, “যন্ত্রপাতির অভাবে আমি বডি (মূল কাঠামো) বানাইতে পারি না। তাই যারা রিকশার বডি দিয়া অটো বানাইতে চায়, তাদেরই কাজ করি শুধু।

“রিকাশারে অটো বানাইতে মোটর-ব্যাটারি-সুইচ যা যা লাগে, সেগুলা দোকান থাইকা কিনা আইনা সেট কইরা দিই।”

রুবেল ৭০ হাজার টাকার মধ্যে একটা ব্যাটারি রিকশা বানিয়ে দেন। তবে বড় দোকানগুলোতে তা বানাতে ৮০-৮৫ হাজার টাকা লাগে।

রুবেলের কাছে একটি ব্যাটারি রিকশা বানিয়ে নিতে এসেছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক সুমন মিয়া। তার মতো অনেকে এখন ব্যাটারিরিকশা চালানোয় ঝুঁকছেন।

কেন? উত্তরে সুমন বলেন, “সাধারণত আমার ডিউটি থাকে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত। তাই বেশিরভাগ দিন সকালে শুয়ে-বসেই সময় কাটে। শুধু বেতনের টাকায় সংসার চলছে না, তাই সকালে অটোরিকশা চালাব বলে চিন্তা করছি।”

ঢাকার মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার চাঁদের মাঠের পাশে অটোরিকশা তৈরি করা হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে ব্যাটারি রিকশা তৈরি করা হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আদাবরের শনির বিল, ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং, মিরপুর-১, হাজারীবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অনেক দোকানেই ব্যাটারি রিকশা তৈরি হতে দেখা যায়। এর বাইরে গাজীপুরের টঙ্গী ও কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর, সাভারের আমিনবাজারসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে বড় কারখানা।

ঘাটারচরের ‘জুবায়েদ অটোরিকশা অ্যান্ড পার্টস’ এ বুধবার দুপুরে নতুন বানানো বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারি রিকশা দেখা যায়।

এই দোকানে প্রচলিত রিকশার কাঠামো দিয়ে বানানো ব্যাটারি রিকশাগুলোর দাম ৮০ হাজার টাকা। আর চালকের মাথার ওপর ছাউনি দিতে চাইলে যোগ হবে ৫ হাজার টাকা। আর স্টিলের ফ্রেমের ছোট চাকার রিকশাগুলোর দাম ব্যাটারির মানভেদে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

‘জুবায়েদ অটোরিকশা অ্যান্ড পার্টস’র মালিক মো. জুয়েল রানা বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকায় অটো চালানোর অনুমতি দেওয়ার পর এর চাহিদা অনেকে বেড়ে গেছে। মাঝ খানে কয়েকদিন চাহিদা কমলেও এখন ধরে আবার বেশি।”

ঘাটারচরের লাবণী পয়েন্ট এলাকার আরেকটি দোকান ‘ফারুক ব্যাটারি হাউজ’। আগে অটোরিকশার ব্যাটারি কেনা-বেচার পাশাপাশি বিভিন্ন রিকশা-ভ্যানের পার্টসের ব্যবসা করতেন তারা। এখন তারাও ব্যাটারি রিকশা বানানো শুরু করেছে।

‘ফারুক ব্যাটারি হাউজ’র কর্মী মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “যেহেতু আগে থেকেই পার্টস বেচতাম আমরা, এখন অটোরিকশার চাহিদা বাড়ায় সম্পূর্ণ রিকশাও বিক্রি করছি।”

হাজারীবাগের ‘আকবর অটোস’ দোকানের মেকানিক তরিকুল ইসলাম জানান, গত জুন মাস থেকেই তাদের দোকানে প্রতিদিন ১২-১৫টি ব্যাটারি রিকশা বিক্রি হচ্ছে। মাঝে কিছুটা কমলেও এখন আবার বেড়েছে।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে কম শোরগোল হচ্ছে না। একবার এটি বন্ধ করার আদেশ আসে তো আরেকবার চালু রাখার। সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে রিকশা বানানোর ব্যস্ততা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ব্যাটারি রিকশার নকশার কোনও ঠিক নেই। একেকটি একেক নকশার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এই দোকানে নগদের পাশাপাশি দৈনিক কিংবা মাসিক কিস্তিতেও ব্যাটারি রিকশা বিক্রি হয়। তবে নগদে দাম পড়ে ৭৫-৮০ হাজার, কিস্তিতে তা বেড়ে ৯০-৯৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়।

কিস্তিতে বিক্রি বেশি হয় জানিয়ে তরিকুল বলেন, “গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে চালালে চালককে প্রতিদিন ৪০০ টাকা জমা দিতে হয়। আবার কিস্তিতে নিজে অটো কিনলেও এমনই টাকা দিতে হয়। মাঝখান দিয়া বছর খানেক পর অটোটা নিজের হয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে শুধু অটোর ব্যাটারি নষ্ট হয়। সেটা বদলাতে লাগে ১৫ হাজার টাকার মতো।”

তিনি জানান, এসব রিকশায় দুই রকম ব্যাটারি ব্যবহার হয়। পাউডার ব্যাটারির দাম ২৫ হাজার টাকা। এই ব্যাটারিগুলো পুরনো হলে সেগুলো জমা দিয়ে নতুন নিতে চাইলে ৯-১০ হাজার টাকা ছাড় পাওয়া যায়। আর পানির ব্যাটারির দাম ৪০-৪৫ হাজার টাকা। এই পুরনো ব্যাটারিগুলো জমা দিলে ২৫-৩০ হাজার টাকা ছাড় পাওয়া যায়।

আদাবরের শনির বিল এলাকার ‘ঢাকা অটোস’র মালিক মো. নাজমুল হোসেন বলেন, “অটোরিকশার দাম বেশি নির্ভর করে এর ব্যাটারির মানের ওপর। তাছাড়া অন্য খরচ প্রায় একই। কেউ মোটর চায় ১২০০ ওয়াটের, কেউবা চায় ১৫০০ ওয়াট। এই মোটরের দাম ১২-১৫ হাজারের মধ্যে।”

যন্ত্রাংশ বিক্রির চেয়ে সম্পূর্ণ রিকশা বিক্রিতে লাভ বেশি বলেই এদিকে ঝুঁকেছেন বলে জানান নাজমুল।

তার বড় দোকানের পাশেই ছোট একটি দোকান নিয়ে ব্যাটারি রিকশা বানাচ্ছিলেন মো. আরিফুল ইসলাম। তিনিও আগে সাইকেল-রিকশার মেকানিক ছিলেন।

“এখন অটোর বাজার ভালো। তাই আমিও বানানো শুরু করলাম। কাম না থাকলে আবার সাইকেল-রিকশা ঠিক করা শুরু করুম,” বলেন তিনি।

প্রতিদিন সড়কে নামছে কত

ব্যাটারি রিকশা চলাচলে বাধা না থাকলেও এই যান যাতে আর না বাড়ে, সেদিকে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। কারণ সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এই রিকশাগুলোকে বড় অন্তরায় হিসাবে দেখেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।

গত বুধবার ব্যাটারি রিকশার চালক, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে ডিএমপি কমিশনার নিয়ন্ত্রণের বার্তা দিলেও প্রতিদিন ঢাকার সড়কে এই যান ৫০০-৭০০টি যোগ হচ্ছে বলেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে মালিক-চালকদের কাছ থেকে।

আবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। তাদের হিসাবে, প্রতিদিন আড়াই হাজারের বেশি ব্যাটারি রিকশা যোগ হচ্ছে রাজধানীর সড়কে।

অটোরিকশার দাম মূলত নির্ভর করে এর ব্যাটারির মানের ওপর। বাকি খরচ প্রায় একই। কেউ মোটর চায় ১২০০ ওয়াটের, কেউ চায় ১৫০০ ওয়াট। এই মোটরের দাম ১২-১৫ হাজারের মধ্যে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
অটোরিকশার দাম মূলত নির্ভর করে এর ব্যাটারির মানের ওপর। বাকি খরচ প্রায় একই। কেউ মোটর চায় ১২০০ ওয়াটের, কেউ চায় ১৫০০ ওয়াট। এই মোটরের দাম ১২-১৫ হাজারের মধ্যে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

প্যাডেল রিকশা নামাতে হলে সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু অননুমোদিত ব্যাটারি রিকশার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের কোনও বালাই নেই। ফলে এই রিকশার সংখ্যা কত, তার কোনও হিসাব নেই।

রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম জানান, ঢাকা শহরে এখন প্রায় ১০ লাখ ব্যাটারি রিকশা চলাচল করে। পাঁচ মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ।

“এখনও প্রতিদিন ৫০০-৭০০ অটোরিকশা সড়কে নামছে। তবে এর বিপরীতে ৩০০-৫০০ রিকশা প্রতিদিন সড়ক থেকে উঠেও যাচ্ছে। সেই হিসেবে রিকশার সংখ্যা খুব একটা বাড়ছে না,” দাবি করেন তিনি।

নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নাদিম বলেন, “নতুন অটো রিকশা নামা বন্ধের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে আমরাও একমত। কারণ এখন যারা আছেন, তাদের আয় কমে যাচ্ছে।

“বড় সমস্যা হচ্ছে কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের অটোরিকশাও ঢাকায় ঢুকে পড়ছে হরহামেসায়। এটা বন্ধের চেষ্টা করছি আমরা।”

ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রাংশ আমদানি ঠেকানোর ওপর জোর দেন নাদিম।

অননুমোদিত ব্যাটারি রিকশা মহাসড়কে পেলে পুলিশ আটকায়। তবুও থামানো যায় না চলাচল ছবি : সকাল সন্ধ্যা

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর হিসাবে, ৫ মাস আগেও ঢাকায় ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ লাখ। সেই সংখ্যা এখন বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

তিনিওি বলেন, “তাই অটোরিকশা বন্ধে শুধু চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালিয়ে উৎপাদন বন্ধে জোর দিতে হবে।”

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারি ও মোটরগুলো আমদানি হয় চীন ও তাইওয়ান থেকে। এই দুটি জিনিসের আমদানির লাগাম টানলে দেশে উৎপাদনও কমবে।

ত্রুটিপূর্ণ যান নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা এখন এতটাই বেড়েছে যে জোর করে এখন এটা বন্ধ করা কঠিম মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই তারা এই যানকে ত্রুটিমুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছেন।

তারা বলছেন, ব্যাটারি রিকশাগুলোর জন্য একটি নকশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাড়াতে এর নকশার সংস্কারও দরকার। ত্রুটিগুলো সংশোধন করার পাশাপশি চলাচলেও শৃঙ্খলা আনতে হবে। 

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ও বিভাগীয় প্রধান (দ্বিতীয় শিফট) প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ব্যাটারি রিকশার ব্রেকে দুর্বলতা কাটানোর ওপর জোর দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “এসব অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

“আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যাটারি রিকশার নকশা পায়ে টানা সাধারণ রিকশার মতোই। সমস্যা হচ্ছে সাধারণ রিকশার ডিজাইন দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী নয়। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক সময়। বেশি গতির কারণে বাঁক নেওয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।”

পুলিশের বাধা না মেনে মহাসড়কে উঠে পড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এসব রিকশাকে একই নকশার আওতায় আনার ওপর জোর দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে প্রায় ৩০ ধরনের অটোরিকশা চলে। সেগুলোর কোনোটি ৩ জন যাত্রী পরিবহন করে, কোনোটিতে আবার ৮ জন যাত্রীও নেওয়া হয়।

“কিন্তু এসব অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।”

ব্রেক নিয়ে বুয়েটের এই অধ্যাপকও বলেন, “সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে।

“সাইকেল কিংবা পায়ে টানা রিকশার ইউ ব্রেক ঠিক আছে। দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় ব্যাটারি রিকশাতেও এই ব্রেকই ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এসব রিকশার কাঠামো ও চাকা অনেক দুর্বল, দ্রুত গতিতে চলাচলের উপযোগী নয়।”

এসব রিকশার ব্যাটারিগুলোও সমস্যার দিকটি তুলে ধরে মোশারফ হোসেন বলেন, “এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকাল খুব বেশি নয়। অর্থাৎ ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া সেসব ব্যাটারি কীভাবে ধ্বংস করা হয়, কেউ জানি না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।”

দুর্ঘটনার কারণ দেখিয়ে ব্যাটারি রিকশা একেবারে বন্ধ করা আর এখন আর সম্ভবপর নয় বলে মনে করেন বুয়েট শিক্ষক হাদিউজ্জামান।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “২০০৯-২০১০ সাল থেকে এরা (ব্যাটারিচালিত রিকশা) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে সঠিক সংখ্যা কেউই বলতে পারে না। সারাদেশে ব্যটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কেউ বলেন ২০ লাখ, কেউবা দাবি করেন ৫০ লাখ। তাই এখন এর সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িয়ে গেছে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে অনেকেই পথে বসে যেতে পারেন।

“এছাড়া ব্যাটারি রিকশা বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসাবে দেখা দিয়েছে যাত্রীদের কাছে। হুট করে এসব বন্ধ করলে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন যাত্রীরা। এসব রিকশা বন্ধের সুযোগ নিয়ে অন্য পরিবহনগুলো ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারে। তাতে মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়বে। সেজন্য আমি বলব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি।”

প্যাডেলচালিত রিকশার বডি দিয়ে বানানো অটোরিকশার দাম পড়ে ৮০ হাজার টাকা। চালকের মাথার ওপর ছাউনি দিতে চাইলে তাতে যোগ হয় আরও ৫ হাজার টাকা। আর স্টিলের ফ্রেমের ছোট চাকার অটোগুলোর দাম ব্যাটারির মানভেদে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
প্যাডেলচালিত রিকশার বডি দিয়ে বানানো অটোরিকশার দাম পড়ে ৮০ হাজার টাকা। চালকের মাথার ওপর ছাউনি দিতে চাইলে তাতে যোগ হয় আরও ৫ হাজার টাকা। আর স্টিলের ফ্রেমের ছোট চাকার অটোগুলোর দাম ব্যাটারির মানভেদে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

হাদিউজ্জামান বলেন, “বর্তমানে একটি অটোরিকশা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সঙ্গে আর ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ বাড়ালেই রিকশাগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব। এর ব্রেকিং সিস্টেম ও কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যার সমাধান করে সেগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিৎ।

“আর অনুমোদনহীন হওয়ায় এটিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু এর দুর্বলতা দূর করে চলাচলের অনুমোদন দেওয়া উচিৎ। এতে চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে, সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।”

“তবে কোনোভাবেই এসব রিকশা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কে চলাচলের পক্ষে নই আমি। এসব রিকশা মহল্লার ভেতরের সড়কে, কিংবা পার্শ্ব সড়কে চলতেই পারে,” বলেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত