১২ জুন, ১৯৯৬, মধ্যরাত। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (তখন নাম ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ডিপারচার লাউঞ্জে একটি প্রাইভেটকার এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি, হাতে তার শুধু ছোট্ট একটি ব্যাগ। লাউঞ্জের ভেতরে ঢুকলেন তিনি, এগিয়ে গেলেন মধ্যপ্রাচ্যগামী একটি ফ্লাইটের বোর্ডিং ডেস্কের দিকে।
এরমধ্যেই বিমানবন্দরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। খবর চলে গেছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে। ওই ব্যক্তি বোর্ডিং শেষ করে ইমিগ্রেশনে আসার পর তাকে অপেক্ষা করতে বলা হলো। ততক্ষণে নানা ধাপ পেরিয়ে খবর চলে গেছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেখান থেকে তাকে দেশত্যাগের সুযোগ না দেওয়ার নির্দেশ এলো।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ওই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে বঙ্গভবন। ঠিক পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর জেলখানার ভেতরে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের ঢুকতে দেওয়ার মতোই আদেশ আসে এদিনও। বঙ্গভবন থেকে ওই ব্যক্তিকে দেশ ছাড়তে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেদিন দেশ ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি। পরে আদালতে রায়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়, তবে পালিয়ে যাওয়ায় তার দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। এখনও বিদেশে পালিয়ে তিনি।
যেদিন তিনি পালাচ্ছিলেন, সেদিনই বাংলাদেশের সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। দিন শেষে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভোটে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরছে আওয়ামী লীগ। তাতে বিমানবন্দরে তাকে প্রথমে আটকে দেওয়ার কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে তখনও রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপির মনোনীত আবদুর রহমান বিশ্বাস, যার বিরুদ্ধে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। রহমান বিশ্বাস বঙ্গভবনে থাকার মধ্যেই রশিদকে দেশ ছাড়তে দেওয়ার নির্দেশটি আসে। তিনি ২০১৭ সালে মারা যান।
রশিদকে সেদিন বঙ্গভবনের নির্দেশেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সকাল সন্ধ্যাকে বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন কর্মকর্তা, যিনি তখন এই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা যখন তার (রশিদ) পরিচয় নিশ্চিত হই, তখন বিষয়টা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। সেখান থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাকে আটকে রাখতে।
“নির্দেশনা অনুযায়ীই আমি কাজ করেছিলাম। কিন্তু ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে জানানো হয়, বঙ্গবভবন থেকে ফোন এসেছে। খন্দকার আব্দুর রশিদকে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই নির্দেশ মানা ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না।”
ওই নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে কুমিল্লার চান্দিনার আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন রশিদ। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ ছেড়ে যাওয়া রশিদ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ঢাকায় ফিরে আসেন। তার ভায়রা, আরেক খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানকে নিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করেন। সেই নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির ‘তারা’ প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন রশিদ। অভিযোগ রয়েছে, নামমাত্র ওই নির্বাচনেও প্রশাসনের মদদে সব ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখা হয়েছিল।
প্রায় সব দলের বর্জনের মধ্যে বিএনপি সেই নির্বাচন করেছিল। কিন্তু আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। ফলে আবার নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের ফল আঁচ করেই পালিয়েছিলেন রশিদ।
‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’ বইয়ের লেখক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাচনের পরদিনই আমরা জেনেছি, ফারুক রহমান এবং সুলতান শাহরিয়ার রশিদসহ কয়েকজন খুনি দেশে থাকলেও আবদুর রশিদ বিদেশ চলে গেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রশাসনে অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার আগেই সে পালিয়ে যেতে পেরেছে।
“পরে খবর নিয়ে জানতে পারি, সেসময়ের রাষ্ট্রপতির ইশারাতেই পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রশিদকে দেশত্যাগের বাধা তুলে নিতে বাধ্য হয়।”
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “খন্দকার আব্দুর রশিদকে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করতে বিশেষ ভবন থেকে নির্দেশ এসেছিল। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব না। তবে সিআইডির একটি প্রতিবেদনে এনিয়ে বিস্তারিত বলা আছে। তাতে তার দেশত্যাগে বিশেষ ওই ভবন থেকে নির্দেশের কথা উল্লেখ আছে।”
২৮ বছর আগে রশিদ এক রাষ্ট্রপতির প্রশ্রয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তার ঠিক ২১ বছর আগে আরেক রাষ্ট্রপতির নির্দেশে রশিদের সহযোগীরা পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকতে পেরেছিল।
তখনকার ডিআইজি (প্রিজন্স) বঙ্গভবনকে জানিয়েছিলেন, একদল মদ্যপ সশস্ত্র সেনাসদস্য জেলখানায় ঢুকতে চায়। বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমেদ ফোনে বলেছিলেন, তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়া হোক। সেই ইচ্ছাপূরণ হয় চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তখন মামলায় রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদকেও আসামি করা হয়েছিল। তবে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি ছাড় পেয়েছিলেন।
দুই বছর পর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল জাতির পিতাকে হত্যার মামলায় ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। তবে উচ্চ আদালত তাদের মধ্যে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
এদের মধ্যে বিচারের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তার আগে ২০০১ সালে আরেক খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
পাঁচ খুনির ফাঁসির ১০ বছর পর আরেক পলাতক খুনি আবদুল মাজেদকে ২০২০ সালে গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের পর তার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়।
রশিদসহ বাকি পাঁচ খুনি এখনও পলাতক। এদের মধ্যে নূর চৌধুরী আছেন কানাডায়। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন রাশেদ চৌধুরী। তবে খন্দকার রশিদ, শরিফুল হক ডালিম এবং রিসালদার মোসলেহউদ্দিন এখন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন মধ্যরাতে দেশ ছাড়ার পর খন্দকার রশিদকে আবার দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে। তবে সেই টকশোতে তিনি দেশ থেকে, না বিদেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত পলাতক আসামি হিসাবে কুমিল্লার চান্দিনায় রশিদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
রশিদ পালিয়ে থাকলেও তার মেয়ে মেহনাজ রশিদ দেশে ফিরেছিলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় তিনি চান্দিনায় স্থানীয়দের তোপে পড়েছিলেন।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট নিহত শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসের ওপর বোমা হামলার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মেহনাজ।
গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাবার নির্দেশে ফ্রিডম পার্টি পুনর্গঠনের কাজ করছিলেন তিনি।
সাত মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর মেহনাজকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।