ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের ওপর হামলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছেন, তেহরানের গোপন পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি ঠেকাতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।
তিনি দাবি করেছেন, তেহরানের বর্তমানে নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও বলছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রমাণ দিয়েছে যে, ইরান সম্প্রতি কারিগরি দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।
তবে নেতানিয়াহুর সমালোচকরা বলছেন, তিনি আরেকটি বিষয় ঠেকাতে আগ বাড়িয়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি কূটনৈতিক চুক্তি, অথবা তার নিজের সরকার পতনের আশঙ্কা।
সমালোচকরা আরও বলছেন, ইসরায়েল গত ২০ বছর ধরেই বলে আসছে ইরান অচিরেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে যাচ্ছে।

নেতানিয়াহুর এই দাবি নির্ভর করছে মূলত ইসরায়েলের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার ওপর। সংস্থাটির দাবি, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) চেয়েও বেশি তথ্য রাখে।
এদিকে গত ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড সেনেটের গোয়েন্দা কমিটিকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা মনে করে, ইরান বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্রিয় চেষ্টা করছে না।
তবে গ্যাবার্ড বলেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করার বহুদিনের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, গত কয়েক বছরে তা শিথিল হয়েছে। এতে ইরানের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে পারমাণবিক অস্ত্রপন্থীদের সাহস বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এটি কোনও পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রের জন্য নজিরবিহীন।
এই সপ্তাহে আইএইএ পরিচালনা বোর্ড যে ২২ পৃষ্ঠার একটি গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়নি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। বরং তাতে বলা হয়েছে, সংস্থাটি ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির কিছু দিক পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি। তেহরান বিশেষ করে তাদের অতীতের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আইএইএ প্রতিবেদন জানায়, তারা নিশ্চিত করতে পারেনি যে ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি আসলে শুধু বেসামরিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে তাতে কোথাও বলা হয়নি যে, ইরান এখনই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে যাচ্ছে।
ওই প্রতিবেদন মূলত তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করে— ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির অগ্রগতি, জাতিসংঘ পরিদর্শকদের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতার মাত্রা ও সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ।
প্রথম বিষয়ে আইএইএ জানায়, ২০১৯ সাল থেকে তারা ইরানের তিনটি অঘোষিত স্থানে— ভারামিন, মারিভান ও তুরকুজ আবাদ— মানবসৃষ্ট ইউরেনিয়াম কণার উপস্থিতি নিয়ে তদন্ত করছে। এই স্থানগুলো ‘আমাদ’ নামের এক গোপন কর্মসূচির অংশ ছিল, যা বহু বছর ধরে জানা আছে এবং ২০০৩ সালেই বন্ধ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আইএইএ প্রতিবেদনের উপসংহারে জানায়, এই তিনটি স্থান এবং এদের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কিছু জায়গা সম্ভবত একটি অঘোষিত গঠিত পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ ছিল। এতে কিছু কর্মকাণ্ডে গোপনে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল।
আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি পরিচালনা বোর্ডকে জানান, দুঃখজনকভাবে ইরান বারবার তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি অথবা কারিগরি দিক থেকে গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তিনি বলেন, ইরান ওই জায়গাগুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে, যা সংস্থার পর্যবেক্ষণকে ব্যাহত করেছে।
আইএইএ জানায়, সফল ইমপ্লোশন পরীক্ষার পর ইরান ঠান্ডা পরীক্ষা চালাতে চেয়েছিল। ঠান্ডা পরীক্ষা মানে হলো, একটি পূর্ণাঙ্গ বোমা, যার কেন্দ্রে থাকবে প্রাকৃতিক অথবা নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম— তবে অস্ত্রমান ইউরেনিয়াম নয়। একইসঙ্গে, তারা বিস্ফোরণ প্রতিরোধক আবরণ পরীক্ষাও করছিল।
সংস্থাটির মতে, ইরানের সাবেক গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপকতা নিশ্চিত হয়েছে। এতে আরও বোঝা যায়, ইরানের বিজ্ঞানী মহলে এই জ্ঞান এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়ে, অর্থাৎ স্থান পরিদর্শনের সুযোগ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএইএ এখনও প্রয়োজনীয় প্রবেশাধিকার পায়নি। তারা নতুন কোনও পারমাণবিক স্থাপনার নকশাও দেখতে পারেনি। ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল থেকে ইরান তাদের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রের তথ্য রেকর্ডিং বন্ধ রেখেছে। যদিও ২০২৩ সালের মে মাসে কিছু ক্যামেরা আবার বসানো হয়, তবে এখনও সংস্থা এসব রেকর্ডিং দেখতে পাচ্ছে না।
ইরানের দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব পদক্ষেপ ২০১৮ সালে ট্রাম্পের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার জবাবে নেওয়া প্রতিরক্ষামূলক পাল্টা পদক্ষেপ।
তৃতীয় বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম জমা করেছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ছিল ২৭৪ দশমিক ৮ কেজি, যা গত এপ্রিল নাগাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৮ দশমিক ৬ কেজিতে— প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি। এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম দিয়ে প্রায় নয়টি পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব।
আইএইএ উপসংহারে জানায়, বর্তমানে এমন কোনও গোপন ও সংগঠিত পারমাণবিক কর্মসূচির কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা পায়নি। সংস্থাটি আরও জানায়, ইরানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র ইসলামী শরিয়ার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে আইএইএ প্রতিবেদন এমন কয়েকজন সাবেক ইরানি কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরে, যারা মনে করেন তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সব সক্ষমতা এখন রয়েছে।
আইএইএ বলেছে, “পর্যবেক্ষণের আওতায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ না হলেও ইরানই একমাত্র অ-পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ যারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও জমা করছে, যা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।”
এপ্রিলে আইএইএ মহাপরিচালক গ্রোসির কাছে জানতে চাওয়া হয়- ইরান কবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনের মতো ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, “তারিখ সবসময় অনুমানভিত্তিক। তবে এটি বছরের ব্যাপার নয়, মাসের বিষয়।”
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান