ফিলিস্তিনের গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধের ছয় মাস হয়ে গেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজার শাসকদল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালালে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ওই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয় এবং ইসরায়েল থেকে হামাস ২৫০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়।
ইসরায়েলের ওপর এমন হামলা আর কখনও হয়নি। ইসরায়েল ওই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করার প্রতিজ্ঞাও ব্যক্ত করে। ইসরায়েলের আরেকটি লক্ষ্য হলো জিম্মিদের উদ্ধার।
তারপর গত ছয় মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বাড়িঘরও সব প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন, ৭৫ হাজার মানুষ।
ইসরায়েলি বাহিনীর কথিত হামাস অবকাঠামো ধ্বংসের চেষ্টায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার ১৭ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ১০ লাখ তীব্র খাদ্য সংকটে আছেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করছে।
গাজার আবাসিক এলাকাগুলো ও রাস্তাঘাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হয়েছে এবং কৃষিজমিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ৭ অক্টোবর থেকে গাজার ৫৬ শতাংশেরও বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
ইসরায়েলের দাবি, তারা হাজার হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। আর গাজার মাটির নিচে হামাসের তৈরি সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্কও ধ্বংস করেছে।
বিবিসি ভেরিফাই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) গণ বিবৃতি ও সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইসরায়েলের দাবিগুলোর পেছনের সাক্ষ্য-প্রমাণও মূল্যায়ন করেছে।
কতজন হামাস নেতা নিহত হয়েছে
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দেওয়া হিসাব মতে, ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে ধারণা করা হয়। হামাসের অনেক ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন ইসমাইল হানিয়াহ, যিনি তাদের সামগ্রিক নেতা হিসাবে বিবেচিত, তিনি বিদেশে থাকেন। তবে এর অনেক সামরিক নেতৃত্ব কাঠামো গাজার অভ্যন্তরে রয়েছে বলে মনে করা হয়।
সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে আইডিএফ বলেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা প্রায় ১৩ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যদিও তারা এই সংখ্যাটি কীভাবে গণনা করেছে তা জানায়নি।
ইসরায়েল সরকারও অনেক হামাস নেতার নাম প্রকাশ করে বলেছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে। অক্টোবর থেকে এইভাবে মোট ১১৩ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে নিহত হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েল। কিন্তু এ বছরের তিন মাসে তথা মার্চ পর্যন্ত গাজায় হামাসের কোনও সিনিয়র নেতার নিহত হওয়ার খবর জানা যায়নি।
তবে ২৬ মার্চ আইডিএফ বলেছে, তারা হামাসের সামরিক শাখার ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ইসাকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড নেতাদের একজন হিসেবে বিবেচিত মারওয়ানই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিহত হামাসের সবচেয়ে সিনিয়র নেতা। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বিশ্বাস করে যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হামাস তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
আইডিএফ বিভিন্ন নাম প্রকাশ করে বলেছে, হামাসের সিনিয়র নেতারা নিহত হয়েছেন। তবে তারা আসলেই হামাসের নেতা বা সদস্য ছিলেন কিনা তা যাচাই করা সম্ভব নয়। যেমন, আইডিএফ মুস্তাফা থুরায়া নামের এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিককে হত্যার পর হামাসের নেতা বলে চালিয়ে দেয়। গত জানুয়ারিতে যখন তার গাড়িতে হামলা করে ইসরায়েলি বাহিনী তিনি তখন দক্ষিণ গাজায় সাংবাদিকতার কাজ করছিলেন। এছাড়া তালিকায় একই নাম একাধিকবারও এসেছে।
গাজার বাইরে হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল-আরৌরি গত জানুয়ারিতে বৈরুতের দক্ষিণ উপশহর দাহিয়েহতে এক বিস্ফোরণে মারা যান। ওই হামলার জন্য ইসরায়েলকেই দায়ী করা হয়।
যাইহোক, বিবিসি যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা বলেছেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ হামাসের অনেক বিশিষ্ট নেতা এখনও বেঁচে আছেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক সিনিয়র বিশ্লেষক মাইরাভ জোনজেইন বলেছেন, “আইডিএফ হামাসের নেতৃত্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ধারেকাছেও যেতে পারেনি।”
মিসেস জোনজেইন বলেন, “হামাসের প্রধান নেতাদের হত্যা করা বা হামাসকে গাজা থেকে উৎখাত দুটির কোনোটিই অর্জনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি আইডিএফ।”
হামাসের হাতে এখন জিম্মির সংখ্যা কত?
ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের হামলার সময় হামাস ২৫৩ জনকে জিম্মি করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে ১০৯ জনকে বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে বা পৃথক চুক্তিতে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরাসরি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে তিন জনকে। ১১ জন জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে তিনজনকে আইডিএফ তাদের একটি অভিযানে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।
ইসরায়েল বলছে, বাকি ১৩০ জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর হামাস বলছে, মৃত জিম্মির সংখ্যা আরও বেশি। আর এরা সবাই আইডিএফের বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। বর্তমানে হামাসের হাতে থাকা কনিষ্ঠতম জিম্মির বয়স ১৮, আর সবচেয়ে বয়স্ক জিম্মির বয়স ৮৫ বছর।
হামাসের হাতে সবচেয়ে কম বয়সী দুই জিম্মি ছিলেন- এরিয়েল ও কেফির। অপহরণের সময় যাদের বয়স যথাক্রমে ৪ বছর ও ৯ মাস বয়স ছিল। তাদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের হাতে জিম্মিদের মধ্যে এখনও ৯৯ জন বেঁচে আছেন বলে ধারণা করা হয়।
হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক কতটা ধ্বংস হয়েছে?
হামাসকে নির্মূল করার অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজার তলদেশে তাদের বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। পণ্য ও মানুষ চলাচলের জন্য হামাস ওই সুড়ঙ্গগুলো ব্যবহার করে।
আইডিএফ মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস অক্টোবরে বলেছিলেন, “গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একটি স্তর এবং তারপরে হামাসের জন্য আরেকটি স্তর আছে। হামাস যে দ্বিতীয় স্তরটি তৈরি করেছে আমরা সেই দ্বিতীয় স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
হামাস বলেছিলো, তাদের টানেল নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার (৩১১ মাইল) প্রসারিত। যদিও স্বাধীনভাবে তাদের সেই দাবি যাচাই করার কোনও উপায় নেই।
বিবিসি আইডিএফের কাছে জানতে চেয়েছিল, তারা হামাসের কয়টি টানেল এবং মোট টানেল নেটওয়ার্কের কতোটা ধ্বংস করেছে। উত্তরে তারা বলেছে, তাদের বাহিনী ‘গাজায় সন্ত্রাসী অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করেছে’।
আইডিএফ মাঝেমধ্যেই হামাসের সুড়ঙ্গ ধ্বংসের প্রমাণ দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত নভেম্বরে তারা গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের নিচের কথিত একটি টানেল নেটওয়ার্কের কিছু অংশের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে। তাদের দাবি, সেটি একটি কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
ইসরায়েল হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কতটা উন্মোচন বা ধ্বংস করতে পেরেছে তা নির্ধারণের জন্য বিবিসি ভেরিফাই ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২৬ মার্চ ২০২৪ এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে গাজার সুড়ঙ্গ নিয়ে আইডিএফের পোস্ট করা সমস্ত বার্তা পর্যালোচনা করেছে।
এসব বার্তার মধ্যে ১৯৮টিতে সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বার্তায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা সুড়ঙ্গ বা সুড়ঙ্গ মুখ সনাক্ত করেছে। আরও ১৪১টি বার্তায় দাবি করা হয়েছে, একটি টানেল ধ্বংস বা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
কিন্তু বেশিরভাগ বার্তায় সুড়ঙ্গের সুনির্দিষ্ট বিবরণ বা নির্দিষ্ট অবস্থান দেওয়া হয়নি। ফলে আইডিএফ হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের ঠিক কতটা উন্মোচন বা ধ্বংস করেছে তার পরিমাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গাজার তলদেশের গোলকধাঁধাটি অসংখ্য সুড়ঙ্গ রুট ও বিভিন্ন আকারের কক্ষসহ বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গঠিত। আর যে বিন্দুতে সুড়ঙ্গটি ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে মিলিত হয় সেগুলো টানেল শ্যাফট বা সুড়ঙ্গ মুখ নামে পরিচিত।
বিবিসি যেসব বার্তা বিশ্লেষণ করেছে তার মধ্যে ৩৬টিতে মোট ৪০০টিরও বেশি টানেল শাফট বা সুড়ঙ্গ মুখের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাইহোক, ভূগর্ভস্থ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ড. ড্যাফনে রিচমন্ড-বারাক বলেছেন, পুরো সুড়ঙ্গের সঙ্গে সুড়ঙ্গ মুখের একটি খাদকে এক করে দেখা বিভ্রান্তিকর হবে। ড. ড্যাফনে ইসরায়েলের রাইচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
তিনি বলেন, “সুড়ঙ্গ মুখ ধ্বংস করলেও সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কটি অক্ষতই থেকে যায়। আমি মনে করি না যে, এই যুদ্ধে অনেক সুড়ঙ্গ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার ছয় মাস পরেও ইসরায়েল তার যুদ্ধের লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পেরেছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। এছাড়া একদিকে প্রতিদিন বেসামরিক মানুষ নিহতের সংখ্যা বেড়ে চলার পাশাপাশি অন্যদিকে এটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, যুদ্ধ কীভাবে শেষ করা হবে বা পরবর্তীতে কী হবে সে বিষয়ে ইসরায়েলের কোনও কার্যকর পরিকল্পনা নেই।
আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে ইসরায়েল
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় সত্ত্বেও গাজায় হামাসকে তাড়া করার দৃঢ় সংকল্প ইসরায়েলকে বৈশ্বিক মঞ্চে ক্রমশ একঘরে দিচ্ছে। নেতানিয়াহু সরকার সব দিক থেকে চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করেছে, ইসরায়েল গাজায় জেনোসাইড চালাচ্ছে এবং এমনকি দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এখন প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ইসরায়েলের অস্ত্রের চালান বন্ধ করার আহ্বানও জোরালো হচ্ছে।
একই সময়ে নেতানিয়াহু ও তার সরকার দেশের ভেতরেও ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে। বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে তার পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল বিষয়ক প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ও পরিচালক খালেদ এলগিন্দি। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, “আমি মনে করি যুদ্ধ ইতোমধ্যে তার সময়কাল ও তীব্রতা এবং মাত্রা ও সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে যে কারও প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এর কোনও শেষ দেখা যাচ্ছে না।”
তবুও নেতানিয়াহু তার নীতি পরিবর্তন করতে অস্বীকার করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে গত সপ্তাহে আল্টিমেটামের পর তিনি গাজায় আরও ত্রাণ সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহর আক্রমণের পরিকল্পনাও বাদ দেননি। গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় ১৪ লাখ মানুষই সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।
রাফায় হামলার পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধের জেরেই গত মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলা গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ভেটো দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায় এবং যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
কিন্তু এলগিন্দি বলেন, “গাজার ভবিষ্যতের জন্য কোনও কার্যকর পরিকল্পনা নেই, শুধু পরের দিন নয়, আজও। কেউ জানে না এই যুদ্ধ কখন শেষ হবে, কীভাবে শেষ হবে।”
বের হয়ে আসার কোনও কৌশল নেই
বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সিএনএনকে বলেছেন, ইসরায়েল একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। কারণ তারা নিজের জন্য হামাসকে নির্মূল করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তা ইসরায়েলিদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হলেও অর্জন করা সম্ভব নয়।
হামাস ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতা দখলের পর থেকে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে। সমস্ত সরকারি ও নিরাপত্তা সংস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
জেরুজালেম-ভিত্তিক আরব-ইসরায়েল সংঘাতের বিশেষজ্ঞ নাথান থ্রাল বলেন, “ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। কারণ হামাস পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত কয়েক মাসে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।”
থ্রাল সিএনএনকে বলেন, “ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চলে হামাসকে পরাজিত করার ঘোষণা দেওয়ার পরও সেখানে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েলি সেনারা মারা যাচ্ছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, এই যুদ্ধের পরেও হামাসের অস্তিত্ব বজায় থাকবে, ইসরায়েল রাফায় আক্রমণ করুক বা না করুক। হামাস গাজার মাটিতে একটি বড় শক্তি এবং এই যুদ্ধের শেষেও তাই থাকবে।”
এর অর্থ হল ইসরায়েলের সামনে এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার কার্যকর কোনও উপায় নেই, থ্রাল ব্যাখ্যা করে বলেন। উল্লেখ্য, গাজা যুদ্ধে প্রায় ২৫০ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে।
থ্রাল বলেন, “তাদের সামনে বাস্তবসম্মত বিকল্প হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজায় দখল চালিয়ে যাওয়া, যা বেশিরভাগ ইসরায়েলিই করতে চায় না। অথবা তাদেরকে গাজা ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু এতে হামাসই গাজার মাটিতে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে থেকে যাবে, যদিও তারা সরকারে নাও থাকতে পারে।”
এলগিন্দি বলেন, “হামাসকে ধ্বংস করার লক্ষ্য কখনোই বাস্তবসম্মত ছিল না। আমি মনে করি, এমনকি আমেরিকান কর্মকর্তারাও বিলম্বে হলেও বুঝতে পেরেছেন যে, এটি সম্পূর্ণ পাগলামি। তারা এই ভয়াবহতাকে এমনভাবে চলতে দিচ্ছে যেন হামাসকে ধ্বংস করার লক্ষ্য ইসরায়েলের নিজস্ব ভবিষ্যত নিরাপত্তাসহ বিশ্বের অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “এটা বাস্তবতার বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন। কারণ হামাসকে ধ্বংস করলেও এমন কিছু তৈরি হবে যা আরও বেশি খারাপ হবে। গাজায় ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে। এতে ১৭ হাজার শিশু এতিম হয়েছে। এরা বড় হলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?”
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের বিশ্বাস হারিয়েছে ইসরায়েল
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান স্টাডিজের মোশে দায়ান সেন্টারের সিনিয়র গবেষক হারেল চোরেভ। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, গাজা নিয়ে ইসরায়েলের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব তার মিত্রদের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তিনি বলেন, “আমাদের বন্ধুরা- প্রথম ও সর্বাগ্রে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স- আমাদের সরকারকে আর বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে না, ইসরায়েলি বাহিনী জানে তারা গাজায় কী করছে বা পরের দিনের জন্য তাদের কোনও কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে না, আমারা সঠিক কাজ করছি।”
নেতানিয়াহু ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গাজার হামাস-পরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি গাজার ‘সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ’ এবং মিশরের সঙ্গে এর দক্ষিণ সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি গাজার বেসামরিক প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেন। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আলোচনার টেবিলের মূল খেলোয়াড়দের অনেকেই নেতানিয়াহুর এসব প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেছে।
এছাড়া নেতানিয়াহু গাজার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপরও ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কথা বলেছেন। এমনকি পশ্চিম তীরের ফাতাহ সরকারের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতেও গাজার শাসনভার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এলগিন্দি বলেন, “এর ফলে সম্ভবত যা ঘটবে তা হলো, গাজার মাটিতে অনির্দিষ্টকাল ধরে ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতি থাকবে।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও সিএনএন