যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে এক ঐতিহাসিক সফরে গিয়েছিলেন চীনে। তার সম্মানে বিশাল এক ভোজের আয়োজন করেছিল তৎকালীন চৌ এনলাই সরকার। ভোজের একটি স্মারকে লেখা ছিল, চীনের জনগণ তাদের খাবার নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত।
বেইজিংয়ে নিক্সনের ওই সফর এবং ভোজের আয়োজন চীন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কয়েক দশকের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিল।
ওই ঘটনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আবারও যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সেই খাবার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন সম্প্রতি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দুবার চীন সফর করেন। এসময় উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্ক স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে খাবার। উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা একে বলছেন ‘খাদ্য কূটনীতি’।
এপ্রিলের শুরুতে জ্যানেট ইয়েলেনের চীন সফর বেশ আলোড়ন তোলে। তখন তার খাবার গ্রহণের কায়দা ও পছন্দ নিয়ে চীনা জনগণ বেশ মুখর হয়ে উঠেছিল। মূলত গত বছরের জুলাইয়ের নিজের প্রথম চীন সফরেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সেবার তিনি দেশটির ইউনান প্রদেশের একটি স্থানীয় রেস্তোঁরায় খাবার খেয়ে মুগ্ধ হন।
তবে এবার কিন্তু স্থানীয় ক্যান্টনিজ ও সিচুয়ান খাবারের প্রতি ইয়েলেনের আগ্রহ তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নেয়নি। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় গুয়াংঝু রেস্তোঁরায় তার চপস্টিক নিয়ে খাওয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মতো। এই ঘটনা ১৯৭২ সালে চীন সফরে নিক্সনের চপস্টিক ব্যবহারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ থমাস ডুবোয়ের মতে, শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারের প্রতি আগ্রহ রয়েছে ইয়েলেনের।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “চীনে খাবার হলো কূটনীতির ভাষা। দেশটির জনগণ তাদের রন্ধনপ্রণালী নিয়ে বেশ গর্বিত। ইয়েলেন ভালো করেই জানতেন যে তিনি কীভাবে খাবেন এবং তা সফরের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে।
“চীনে খাবার কেবল খাওয়া-দাওয়া নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। তাই আপনি যদি সেখানে বাজেভাবে খাবার খান, একে অতিথিদের প্রতি আপনার অসম্মানজনক আচরণের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হবে।”
তিনি আরও বলেন, চীনে ইয়েলেনের খাওয়ার বর্ণনা করতে ‘চিয়ানক্সু’ শব্দের ব্যবহার করা হয়। এই শব্দের অর্থ ‘বিনয়ী’। চীনাদের কাছে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো বিনয়।
ডুবোয়েরের ভাষ্যে, “চীনে ভালো খাবার ও খাওয়ার নিয়ম-কানুন জানা একটি গভীর নৈতিক দর্শনের অংশ। এর মূল ভাবনা হলো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নম্র হওয়া। যেমন চীনে এসে চপস্টিক ব্যবহার করা।”
চীনে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে খাবারের কূটনৈতিক গুরুত্ব অনেক। বেইজিংয়ে কর্মরত ইউরোপীয় এক কূটনীতিকের মতে, চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সময় একত্রে খাওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, “শীর্ষস্থানীয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে খাওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেখানেই খোলামেলা ও স্পষ্ট আলোচনা করা যায়। উভয় পক্ষই সম্পর্ক গাঢ় করতে কৌশলগতভাবে রাতের খাবারকে ব্যবহার করে।”
বেইজিংয়ে ওই কূটনীতিককে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাকে চীনা ভোজের রীতিনীতি শেখানো হয়েছিল। খাবারের টেবিলে কে কোথায় বসবে এবং আতিথেয়তা করার নিয়ম ভালো করে শেখানো হয়। এমনকি ওই কূটনীতিকের দেশের অন্য মন্ত্রীদেরও চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের আগে এসব রীতিনীতি সম্পর্কে জানানো হয়।
চীনা ভোজের রীতিনীতি অনেকটা জটিল। যাদের খাবারে অ্যালার্জি আছে, এক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হতে পারে। চীনা খাবারে বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকবে।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে ইউরোপীয় মন্ত্রীদের সৌজন্যে এক ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে তাদের যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তাতে অনেক মন্ত্রীরই অ্যালার্জি ছিল। এসব খাবারের মধ্যে দুগ্ধজাত খাবার থেকে ছিল শেলফিস।
ওই কূটনীতিক বলেন, “একজন চীনা কর্মী আমাকে জানান, আমাদের মন্ত্রীদের বিভিন্ন ধরনের খাদ্যে অ্যালার্জি থাকায় তাদের জন্য এই ভোজের পরিকল্পনা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। খাদ্যাভ্যাসের এই পার্থক্য ভোজের আয়োজনকে জটিল করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে অতিথি ও আয়োজকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।”
ইয়েলেনের চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার সাত সেকেন্ডের ভাইরাল ভিডিওটি প্রথমে একটি সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। ধারণা করা হয়, সোশাল মিডিয়ার ওই অ্যাকাউন্টটি নিয়ন্ত্রণ করে বেইজিং প্রশাসন। বেশ কয়েকটি দেশের সংবাদমাধ্যমও বেশ ফলাও করে এনিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। সেসব সংবাদে ইয়েলেনের খাবারের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
জনপ্রিয় চীনা অ্যাপ উইচ্যাটে সাবেক সাংবাদিক ঝ্যাং ফেং লেখেন, ইয়েলেনের ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করা চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার জন্য নতুন ঘটনা। কারণ তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের প্রতি বেশ ‘শীতল’ আচরণ করছে। ইয়েলেনের সফর চীনা জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চীনা জনমনে নেতিবাচক ধারণা ছিল। ২০১৭ সালে ট্রাম্প চীন সফরের সময় চীনা খাবার গ্রহণ করেননি। এতে চীনা জনমত আরও নেতিবাচক হয়েছিল। তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে চীনা জনমত কিছুটা ইতিবাচক হয়েছে।
চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ইয়েলেনের সফরকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের প্রতি তাদের নীতি পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝা যায়। দেশিয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে চায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই কৌশলের পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭২ সালে নিক্সনের সফরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে চীনা কর্মকর্তারাও খাবারের কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। ওই সময় সাংবাদিক এডগার স্নোর মতো শাসকদলের প্রতি সহানুভূতিশীল আমেরিকানদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভোজে উপস্থিত থাকার ছবি ব্যাপকভাবে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছিল।
তবে এসব কৌশলমূলক কূটনীতি নিয়ে সমালোচনাও কিন্তু আছে।
বিখ্যাত ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “চীনা জনগণ বিশ্ববাসীকে আমাদের খাবার উপভোগ করতে স্বাগত জানায়। তবে এর মানে এই নয় যে, তারা ভিত্তিহীন সমালোচনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে না।”
আরেক কট্টর সমালোচক বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার সাবেক সাংবাদিক মিং জিনওয়েই তার পেশাগত সহকর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘আশাহীনভাবে মুগ্ধ’ হওয়ার অভিযোগ করেছেন। তিনি তাদের ‘স্পিরিচুয়াল আমেরিকান’ বলে অভিহিত করেছেন। তার দাবি, চীনে যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম এখন ‘দেউলিয়া’ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চীনের জনমতকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, সে বিষয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিসিপির বিতর্ক প্রকাশ পেয়েছিল ব্লিনকেনকে দেওয়া অভ্যর্থনার ঘটনায়। ব্লিনকেন গত এপ্রিলের শেষের দিকে চীন সফর করেছিলেন। সেসময় তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
ব্লিনকেনও তখন বেইজিং ও সাংহাইয়ের কয়েকটি রেস্তোঁরায় খেয়েছিলেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস একজন জনপ্রিয় চীনা ফুড ভ্লগারদের সঙ্গে তার একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছিল, যেখানে ব্লিনকেনকে চপস্টিক দিয়ে খেতে দেখা যায়। তবে তার খাওয়ার দৃশ্য ইয়েলেনের মতো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি।
ইয়েলেনের চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার দৃশ্য সোশাল মিডিয়ায় যে অ্যাকাউন্ট প্রকাশ করেছিল, তারা কিন্তু ব্লিনকেনের খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেনি। তবে অ্যাকাউন্টটি যুক্তরাষ্ট্রের ভুল কাজ নিয়ে চীনা বক্তব্যগুলো তুলে ধরেছিল। এর মধ্যে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউক্রেনের বিষয়গুলো ছিল।
চীনের সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্ম উইবুতে ব্লিনকেনের চীন সফরের সময় সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ছিল তার বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকার। সেখানে ইসরায়েলের গাজায় হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে তাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়েছিল।
ইয়েলেনের খাওয়ার ভিডিওর চেয়ে ব্লিনকেনের সাক্ষাৎকার অনেক বেশি প্রচার পায়। সাক্ষাৎকারের সঙ্গে সম্পর্কিত হ্যাশট্যাগটি উইবুর শীর্ষ ১০টি আলোচিত বিষয়ের একটিতে পরিণত হয়েছে, যা ৬৭ মিলিয়নেরও বেশি বার দেখা হয়। ইয়েলেনের খাওয়ার ভিডিও সম্পর্কিত হ্যাশট্যাগগুলোর তুলনায় এটি প্রায় দ্বিগুণ।
বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারটি স্বাভাবিকভাবে ভাইরাল হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অতীতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কিত হ্যাশট্যাগগুলোকে প্রভাবিত করার অভিযোগে উইবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল।
শনিবার সন্ধ্যায় ব্লিনকেন যে সাংহাই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন সেটি প্রায় ৮০ শতাংশ ভর্তি ছিল। একজন কর্মী জানান, রেস্তোরাঁটি একটি পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থিত বলে সবসময় ব্যস্ত থাকে। ব্লিনকেনের সফরের কারণে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি।
অন্য অনেক দেশও খাদ্য কূটনীতির শক্তিকে স্বীকার করে।
কিছু দিন আগে প্যারিসে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে ফরাসি মদ ‘কনিয়াকের’ উপর শুল্ক আরোপ না করার জন্য ধন্যবাদ জানান। জানুয়ারিতে বেইজিং ইউরোপীয় ব্রান্ডি নিয়ে একটি অ্যান্টি-ডাম্পিং তদন্ত শুরু করেছিল, যা অনেকেই মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে তদন্তের প্রতিশোধ।
ম্যাক্রোঁ পরে শি জিনপিং ও তার স্ত্রীকে পিরিনেজ পর্বতমালার একটি মনোরম গ্রামে নিয়ে যান। সেখানে তাদের স্থানীয় খাবার ও ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
আর ম্যাঁক্রো শি জিনপিংকে বিদায়ী উপহার হিসাবে কী দিয়েছিলেন? অবশ্যই, দুই বোতল কনিয়াক।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা