অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বিদেশি ঋণ ১১২ বিলিয়ন (১১ হাজার ২০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার; তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৭৩৫ কোটি ডলার। আর ১০ বছরে ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন (১১ হাজার ২১৫ কোটি) ডলার। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ। সেই হিসাবে, বর্তমানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ ডলার বা প্রায় ৭৭ হাজার ৮৩৬ টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের অঙ্ক ছিল মাত্র ২৫৭ ডলার।
তিন মাস আগে মার্চ শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৪৮০ কোটি (১০৪.৮০ বিলিয়ন) ডলার। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর আগে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দেশে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি (১০৩.৭৯ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবেই এক বছরে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন (৮৫০ কোটি) ডলার; তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৭৩৫ কোটি (৭.৩৫ বিলিয়ন) ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুন শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমলেও সরকারি ঋণ বেড়েছে।
বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ জুন শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে মার্চে ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ২৩৮ কোটি (৯২.৩৮ বিলিয়ন) ডলার, যা মার্চে ছিল ৮ হাজার ৪৯২ কোটি (৮৪.৯২ বিলিয়ন) ডলার।
মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের অংশ ৮২ শতাংশ, আর বেসরকারি খাতের অংশ ১৮ শতাংশ।
হিসাব বলছে, তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এতেই বিদেশি ঋণ বেড়ে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলার হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক ঋণের চিত্র বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত ১০ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণের মাইলফলক অতিক্রম করে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেওয়ার বছরে (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি (১৯ বিলিয়ন) ডলারের কিছু কম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর পর ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ১১৯ কোটি (২১.১৯ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৩৬৩ কোটি (১০৩.৬৩ বিলিয়ন) ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১২২ টাকা হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৬৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি দপ্তর মিলিয়ে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৪২১ কোটি ডলার। আর বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি ছিল ১ হাজার ৯৪২ কোটি ডলার।
একই বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৪৩৭ কোটি (১০৪.৩৭ বিলিয়ন) ডলার। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ কমে ৭৪ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে বিদেশ থেকে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪৪২ কোটি ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ডলার।
গত বছরের ডিসেম্বরে মোট ঋণের মধ্যে বিদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬৯ কোটি (৯০.৬৯ বিলিয়ন) ডলার। আর সরকারি ও বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ এসেছিল ১ হাজার ২৯৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাড়ে ১৫ বছরে সরকার প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ করে। গণ-আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার আগে জুলাই পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার।
বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি উদ্বেগের জায়গায় যাচ্ছে বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ এন্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপেমন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৫ সাল থেকে বিদেশি ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প করা হয়েছে। এসব ঋণের বেশিরভাগই দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বা সরবরাহকারী ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়। এসব ঋণের বিপরীতে এখন বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।”
এম এ রাজ্জাক বলেন, “বছরে চার বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হচ্ছে, এটি বেশি মনে হতো না, যদি ওই সব ঋণের সদ্ব্যবহার করতে পারতাম; অর্থনীতিতে যদি গতি থাকত। কিন্তু এসব ঋণের প্রকল্পে অপচয়, তছরুপ ও দুর্নীতি হয়েছে।
“এখন কিছুটা উন্নতি হলেও বেশ কিছুদিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মধ্যে ছিল। ওই সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রপ্তানি আয় যদি বাড়াতে পারতাম, তাহলে ডলার আসত। তখন বিদেশি ঋণ পরিশোধে সমস্যা হতো না। তাই বিদেশি ঋণ পরিশোধ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধ আরও উদ্বেগ বাড়াতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশকে তুলনামূলক বেশি সুদে বিদেশি ঋণ নিতে হয়। অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার কাছে নমনীয় ঋণ ছাড় কমেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে তাদের ঋণ ছাড় বন্ধ করেছে বা কমিয়ে দিয়েছে।
এম এ রাজ্জাক বলেন, “ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ নিয়ে আরও চাপে পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা উত্তরণের পর বিদেশি সহায়তার উৎস কমে যাবে। অন্যদিকে বিদেশি ঋণ নিয়ে এর সদ্ব্যবহার করতে পারি, এমন উদাহরণ নেই। এজন্য দেশের অনেক প্রকল্পের সময় ও খরচ বেড়েছে। ভবিষ্যতে ঋণের সরবরাহের চাপ বাড়বে। আবার ঋণের অর্থ পরিশোধও চাপে থাকবে। বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অসম্ভব উদ্বেগের জায়গায় যাচ্ছে।”
এ প্রসেঙ্গ বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, অবকাঠামো প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ- এই তিনটি কারণেই ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। পাশাপাশি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের চাপও বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “দেশের বিদেশি ঋণের বড় অংশ সরকারের, যা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। তবে অতীতে কিছু প্রকল্পে অপচয় হয়েছে, যা এখন বন্ধ করা জরুরি।”
“জিডিপি অনুপাতে ঋণ এখনও সহনীয় হলেও সুদ ও কিস্তি পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর চাপ বাড়ছে। তাই পরিশোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে কাঠামোগত সংস্কার ও কার্যকর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন,” বলেন জাহিদ হোসেন।

