সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর আবারও আলোচনায় ভারতের কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই ও তার গ্যাং। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে বলিউড অভিনেতা সালমান খানকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে।
বর্তমানে গুজরাটের সবরমতি সেন্ট্রাল জেলে বন্দি লরেন্স বিষ্ণোই কারাগার থেকেই তার গ্যাং সদস্যদের একটি জটিল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন।
বাবা সিদ্দিকী হত্যায় লরেন্স বিষ্ণোইয়ের সন্দেহভাজন ভূমিকার প্রেক্ষিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার গ্যাং আবু সালেম, ছোটা রাজন ও দাউদ ইব্রাহিমদের মতো গ্যাং ওয়ার এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ ফিরিয়ে আনতে পারে।
১৯৭০ এর দশক থেকে তিন দশক ধরে দাউদ ইব্রাহিমরা মুম্বাইয়ে রাজত্ব করেছিল।
জেল থেকে বিষ্ণোইয়ের অপারেশন
বিষ্ণোই গ্যাং কোনো ছোট-খাটো সিন্ডিকেট নয়। তাদের কার্যক্রম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত।
জেলে বন্দি থেকেই লরেন্স বিষ্ণোই তার অপরাধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঘন ঘন চাঁদাবাজি করে এবং হুমকি বাণিজ্য চালায়।
ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) দাবি করেছে, বিষ্ণোই তার শক্তিশালী সম্পর্ক এবং জোটকে ব্যবহার করে কারাগার থেকেই কাজ করছে। তার মিত্রদের মধ্যে খালিস্তানপন্থী সংগঠনও রয়েছে।
লরেন্স ইচ্ছাকৃতভাবেই জামিনের আবেদন থেকে দূরে থাকেন এবং নিউজ ১৮-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ডাব্বা কলিং’ এবং ভিওআইপি-র মাধ্যমে তার সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংসহ ভারতের অপরাধীরা ‘ডাব্বা কলিং’ নামে পরিচিত একটি অবৈধ কৌশলে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং স্ট্যান্ডার্ড মোবাইল নেটওয়ার্কগুলোর পক্ষে এসব কল ট্র্যাক করা সম্ভব হয় না।
এনডিটিভি জানিয়েছে, বিষ্ণোই সিগন্যাল এবং টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমেও জেল থেকে ভারতে এবং বিদেশে তার সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এই বছরের শুরুর দিকে পাকিস্তানের গ্যাংস্টার শাহজাদ ভাট্টির সঙ্গে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের কথোপকথনের একটি ভিডিও টেপ সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
গ্যাং সদস্য
বিষ্ণোইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া জসবিন্দর সিং ওরফে রকি।
পাঞ্জাবের ফাজিলকার বাসিন্দা রকি ছাত্র রাজনীতির আড়ালে রাজস্থান-পাঞ্জাব সীমান্তে অবস্থিত শ্রী গঙ্গানগরের পাশাপাশি ভরতপুরের মতো শহরগুলোতে বিষ্ণোইকে তার কার্যক্রম প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিলেন।
২০২০ সালের মে মাসে রকি হিমাচল প্রদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংস্টার জয়পাল ভুল্লার হাতে খুন হন।
ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) দাবি করেছে, বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ৭০০ জনেরও বেশি বন্দুকধারী পাঁচটি রাজ্যে কাজ করছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের সংযোগ রয়েছে।
গ্যাংটির অন্তত ৩০০ শুটার পাঞ্জাবের বাসিন্দা।
সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে গ্যাংটি তরুণদের নিয়োগ দেয় এবং প্রায়ই তাদের কানাডার মতো পশ্চিমা দেশগুলোতেও অভিবাসনের সুযোগ দেয়।
হরবিন্দর সিং রিন্দার মতো খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারত্ব গ্যাংটির আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে। খালিস্তানিরা পাঞ্জাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য বিষ্ণোইয়ের শুটারদের ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদন মতে, বিষ্ণোই গ্যাং তার অপারেশনগুলোর জন্য দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানি থেকে অনুপ্রেরণা নেয় বলে ধারণা করা হয়, যা একটি করপোরেট ব্যবসার মতোই।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার ছাড়াও, তথ্য সংগ্রহ, আইনি সমস্যা এবং রসদ পরিচালনার জন্য বিষ্ণোই গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগ এবং কর্মী রয়েছে।
লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংস্টার জগ্গু ভগবানপুরিয়ার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং সম্পাত নেহরা ও হরিয়ানার গ্যাংস্টার কালা জাথেদির সঙ্গেও বন্ধুত্ব করেছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের মধ্যে আছেন- ভাই আনমোল বিষ্ণোই, যিনি সিধু মুসেওয়ালা হত্যায় জড়িত ছিলেন এবং গোল্ডি ব্রার, যিনি বন্দুকধারীদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের অপারেশন এবং যোগাযোগের তত্ত্বাবধান করেন।
প্রথম যেভাবে আলোচনায়
লরেন্স বিষ্ণোই ও তার গ্যাং সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে ভারতজুড়ে আলোচনায় আসে। সে বছর তার এক সহকর্মী সম্পাথ নেহরা সালমান খানের মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাড়িতে হামলার জন্য রেকি করলে গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
নেহরা দাবি করেছিলেন, সালমান খানকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে।
১৯৯৮ সালে সালমান খান রাজস্থানের যোধপুরে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় দুটি কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা করেছিলেন। বিলুপ্ত প্রজাতির এ হরিণ বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র।
তারা মনে করেন, হিন্দুদের বিষ্ণোই গোত্রের প্রবক্তা ভগবান জাম্বেশ্বরের পুনরুত্থানের প্রতীক কৃষ্ণহরিণ। আর এই অপরাধেই সালমান খানকে হত্যা করতে চায় বিষ্ণোই গ্যাং।
২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালাকে পাঞ্জাবের মানসায় গুলি করে হত্যার পর বিষ্ণোইয়ের নাম ফের আলোচনায় আসে।
বিদেশে অবস্থানরত গোল্ডি ব্রার এই হত্যার দায় স্বীকার করে দাবি করেন যে, এটি বিষ্ণোইয়ের সহযোগিতায় করা হয়েছিল। সেসময় বিষ্ণোই তিহার জেলে আটক ছিল।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সুখদেব সিং গোগামেডি নামের একজন ডানপন্থী নেতা তার জয়পুরের বাসভবনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্রধারীরা গুলি চালানোর আগে চায়ের টেবিলে গোগামেডির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। পরে বিষ্ণোই গ্যাং সদস্য রোহিত গোদারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।
২০১৮ সালে আদালতের এক হাজিরায় লরেন্স বিষ্ণোই সালমান খান সম্পর্কে উদ্বেগজনক বিবৃতি দিয়েছিলেন।
তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, “আমরা যোধপুরে সালমান খানকে হত্যা করব। আমরা ব্যবস্থা নিলেই সবাই জানতে পারবে। আমি এখন পর্যন্ত কিছুই করিনি, তারা বিনা কারণে আমার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনছে।”
২০২২ সালে সালমান খানের বাবা সেলিম খান তাদের বান্দ্রার বাসভবনের কাছে সকালে হাঁটার সময় একটি হুমকিমূলক চিঠি পেয়েছিলেন। নোটে লেখা ছিল, “তুমহারা মুস ওয়ালা কার দেনে (তুমিও মুস ওয়ালার মতো শেষ হবে)।”
২০২৩ সালের মার্চে সালমান খানের ম্যানেজারের কাছে একটি হুমকিমূলক ইমেইল পাঠানো হয়েছিল। ওই ইমেইলে এক সাক্ষাৎকারে লরেন্স বিষ্ণোই সালমান খানের প্রতি যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন তার উল্লেখ ছিল।
বিষ্ণোই দাবি করেছেন, সালমান খান তার সম্প্রদায়কে হেয় করেছেন এবং তার উদ্দেশ্য অর্থ নয় বরং সালমানের ক্ষমা প্রার্থনা।
গত বছরের নভেম্বরে লরেন্স বিষ্ণোই পাঞ্জাবি গায়ক গিপ্পি গ্রেওয়ালকে সম্বোধন করে ফেসবুকে একটি বার্তা পোস্ট করেছিলেন।
ওই পোস্টে লেখা ছিল, “আপনি সালমান খানকে ভাই মনে করেন, কিন্তু এখন আপনার ‘ভাই’য়ের আপনাকে বাঁচানোর সময় এসেছে। এই বার্তাটি সালমান খানের জন্যও— দাউদ তোমাকে বাঁচাবে এমন বিভ্রান্তিতে থেকো না; কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
এই বছরের এপ্রিলে মুম্বাইয়ে সালমান খানের বাসভবনের বাইরে একাধিক রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছিল। এতে সালমান তার চারপাশের নিরাপত্তা বাড়ান। দুই সন্দেহভাজন পরে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের কথা স্বীকার করেছে।
তিনবারের বিধায়ক এবং মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিক গত শনিবার রাতে (১২ অক্টোবর) বান্দ্রায় তার ছেলে বিধায়ক জিশান সিদ্দিকের অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হন।
শুবু লোনকার নামের এক ব্যক্তি রবিবার ফেসবুকে একটি পোস্ট করা ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। ধারণা করা হচ্ছে তার আসল নাম শুভম রামেশ্বর লোনকার, যিনি বিষ্ণোই গ্যাংয়ের একজন সহযোগী।
বিষ্ণোইয়ের উত্থান যেভাবে
৩১ বছর বয়সী গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই ওরফে বলকরণ বারার পাঞ্জাবের ফিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি সচ্ছল কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান ছিলেন।
হাইস্কুল পর্যন্ত পড়ার পর বিষ্ণোই চণ্ডীগড়ে চলে আসেন এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএভি কলেজে ভর্তি হন।
সেখানে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ২০১১-২২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের (এসওপিইউ) সভাপতি হন।
পরে তিনি অপরাধজগতে ঢুকে পড়েন। একটি হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে প্রথম ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয় ২০১০ সালের এপ্রিলে। একই মাসে অনুপ্রবেশের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরেকটি এফআইআর করা হয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে একটি লাঞ্ছনা এবং সেল ফোন ছিনতাইয়ের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তিনটি মামলাই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।
বিষ্ণোইকে ২০১২ সালে বাথিণ্ডায় প্রথমবার কারাগারে পাঠানো হয়। তারপর মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (এমসিওসিএ) এর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে তাকে তিহার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।
২০১৩ সালে বিষ্ণোই লুধিয়ানা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন নির্বাচন এবং সেই সঙ্গে মুকত্সারের সরকারি কলেজ নির্বাচনে বিজয়ী একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হত্যা করেছিলেন।
চাঁদাবাজি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হত্যাসহ বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে দুই ডজনেরও বেশি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মদ ও অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসার পাশাপাশি, তার দল প্রায়ই খুনিদের রক্ষা করত। গুজরাটের অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড (এটিএস) আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানের মামলায় বিষ্ণোইকে রাজ্যে নিয়ে আসে।
তথ্যসূত্র: ফার্স্টপোস্ট