ছয় বছরের ছোট্ট সাফরান করিম। এতদিন জানত, বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছেন। তাই বড় হয়ে রকেট চালিয়ে সেখান থেকে বাবাকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা সাজাত সে।
কিন্তু সেই পরিকল্পনা অনেকটা যেন তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ল, যেদিন মা তাকে নিয়ে গেলেন কবরস্থানে। দেখালেন বাবার কবর; জানালেন, এই মাটির ঘরেই শুয়ে আছেন তার বাবা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম।
সাফরানের হিসাব মেলে না। কবরের ওইটুকু জায়গায় বাবা কীভাবে ঘুমাচ্ছেন তা তার মাথায় আসে না! বারবার মাকে প্রশ্ন করে, বাবা ওইটুকু জায়গায় কীভাবে ঘুমাচ্ছেন? বাবা এখন কী করছেন? কীভাবে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে?
ছেলের প্রশ্নবানে জর্জরিত শারমিন আক্তার দিশেহারা হয়ে যান। বুঝতে পারেন না, কীভাবে সাফরানকে বোঝাবেন, কীভাবে তার অসীম প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
সাবেক এএসপি আনিসুল করিম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় ঢাকার আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে। সেখানে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালটির কর্মীদের ধস্তাধস্তিতে তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলাটি এখন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। আগামী মঙ্গলবার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলাটিতে আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ ও ভাই রেজাউল করিম সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদৌ কবে বিচার শেষ হবে কিংবা অপরাধীরা সাজা পাবে কিনা, তা নিয়ে ভীষণ সন্দিহান আনিসুলের পরিবার।
আনিসুলের বাবা, ভাই ও স্ত্রীর কেবল একটাই চাওয়া, যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা।
বাবা যখন মারা যান তখন সাফরান ছোট ছিল, ফলে কিছুই বুঝত না। মা তাকে বোঝাতেন, তার বাবা আকাশের তারা হয়ে গিয়েছে। সাফরানও ভাবত, রকেটে করে গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসবে।
কিন্তু এই চার বছরের সে বড় হয়েছে, স্কুলে যায়। বন্ধুদের বাবাদের স্কুল থেকে নিয়ে যেতে দেখে মন খারাপ করে, অভিভাবক সভায় সবার বাবা-মা যায়, ওর কেন কেবল মা যা সেটা ভেবেও কষ্ট পায়।
আনিসুল করিমের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, “দিন দিন যত বড় হচ্ছে ওর মধ্যে বাবাকে মিস করার বিষয়টাও বাড়ছে। স্কুলের প্যারেন্টস ডে’তে ওর বন্ধুদের বাবাকে দেখে। এটা দেখে ওর অনেক মন খারাপ থাকে। ছেলে যখন বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে, তখন আমার কোনও উত্তর থাকে না।
“বাবার কবর দেখানোর আগে সাফরান বলত, বাবা কোথায়? বলতাম, বাবা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে। তখন ও রকেটে করে গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসতে চাইত। কিন্তু বাবার কবরটা দেখে ও চুপচাপ হয়ে গেছে। এ কারণেই এতদিন কবরটা দেখাইনি। কবর দেখে বাসায় আসার পর জিজ্ঞাসা করে, ওইটুকু জায়গায় বাবা কীভাবে ঘুমাচ্ছে? বাবার বাসা এত ছোট কেন? ওর এসব প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে নেই।”
যাদের কারণে তার সন্তান বাবাহারা হয়েছে তাদের শাস্তি দেখতে চান শারমিন।
তিনি বলেন, “সবাইকে ফাঁসি দিলেও তো ওকে (আনিসুল) ফেরত পাবো না। কিন্তু দায়ীদের সাজা হলে মনে শান্তি পাবো। একটা জ্যান্ত মানুষকে কীভাবে মেরে ফেলল!”
সাফরানকে বড় করার ক্ষেত্রে ভীষণ সতর্ক শারমিন। তিনি বলেন, “আমি ওকে ওর বাবার সবকিছুর মধ্যেই বড় করেছি। ওর বাবা নেই, কিন্তু তার সবকিছু যা যেখানে ছিল সেভাবেই আছে। চেষ্টা করছি সাফরান যেন ওর বাবাকে নিয়েই বড় হয়। এখন বাবার ছবি না দেখলে ঘুম হয় না সাফরানের।”
মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, “দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেল, এখনও বিচার শেষ হলো না। বিচারের জন্য মামলা করেছিলাম। আমি তো আর বিচার করতে পারব না। একজন বাবা হিসেবে, বীর মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে প্রত্যাশা, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি। আমার ৭৫ বছর বয়স হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছি, হাঁটতে-চলতে পারি না। মৃত্যুর আগে অন্তত ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।”
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম কাইয়ুম জানালেন, কিছুদিন আগেই তিনি এই আদালতে যোগ দিয়েছেন। মামলাটি সম্পর্কে জেনেছেন।
তিনি বলেন,“এরই মধ্যে কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে চেষ্টা করব। ভুক্তভোগী পরিবার যেন ন্যায় বিচার পায় তা নিশ্চিত করব।”
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, এএসপি আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়।
মামলার গতিবিধি
আনিসুল করিম হত্যা মামলায় ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এ কে এম নাসির উল্যাহ।
সেখানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
এছাড়া মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ মারা যাওয়ায় এবং আরেক আসামি ডা. নুশরাত ফারজানার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতির সুপারিশও করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এরপর ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ১৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদালত।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন, মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহামুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন, হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদোয়ান সাব্বির, হাসপাতালের কর্মচারী মাসুদ খান, জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম কুমার পাল, লিটন আহম্মেদ, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল-আমিন।
আসামিদের মধ্যে অসীম কুমার পাল কারাগারে, শাখাওয়াত হোসেন পলাতক রয়েছেন। বাকি ১৩ আসামি জামিনে আছেন।
ঘটনাক্রম
আনিসুল করিমের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। সেখানে লেখাপড়া ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় বসেন। সেই পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হন তিনি। সবশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শুরুতে আনিসুল করিম হত্যা মামলার তদন্ত করে আদাবর থানা। পরে আদালতের নির্দেশে পুনঃতন্তের ভার পায় পিবিআই।
সংস্থাটির তদন্তে উঠে আসে ঘটনাক্রম। সেখানে বলা হয়, ঘটনার তিন–চার দিন আগে হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে পড়েন এএসপি আনিসুল। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সকালে পরিবারের সদস্যরা তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের পরামর্শ দেন আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির। সে অনুযায়ী, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আনিসুলকে।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবদেন বলা হয়েছিল, মাইন্ড এইড হাসপাতালের নিচতলায় যখন স্বজনরা ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন তখন আনিসুলকে শৌচাগারে নেওয়ার কথা বলে দ্বিতীয় তলার অ্যাগ্রেসিভ রুম বা মানসিক রোগীদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের কক্ষের সামনে নিয়ে যান হাসপাতালের মালিকদের একজন ও পরিচালক আরিফ মাহমুদ। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আনিসুল তার সঙ্গে যান। আরিফ মাহমুদের সঙ্গে দ্বিতীয় তলায় যান হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদুওয়ান সাব্বির, তিনিও মালিকদের একজন। এছাড়া ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, বাবুর্চি মো. মাসুদ, ওয়ার্ড বয় সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, জোবায়ের হোসেন ও তানিফ মোল্লা। ওয়ার্ড বয় লিটন আহম্মেদ ও সাইফুল ইসলাম আগে থেকেই দোতলায় ছিলেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আনিসুলকে দোতলায় বসতে বলা হলে তিনি নিচে নামতে চান। এ সময় আনিসুলের হাত ধরেন আরিফ। হাত সরিয়ে নিতে গেলে তা আরিফের মুখে লাগে। একপর্যায়ে আনিসুল ক্ষিপ্ত হয়ে মাসুদ ও সজীবকে চড় মারেন। পরে আরিফের নির্দেশে আনিসুলকে জোর করে নেওয়া হয় ওই বিশেষ কক্ষে। সেই কক্ষের মেঝেতে রাখা ম্যাট্রেসের ওপর আনিসুলকে উপুড় করে ফেলা হয়। আনিসুলের পিঠের ওপর চেপে বসেন মাসুদ ও তানভীর। তানিফের আনা ওড়না দিয়ে আনিসুলের দুই হাত পেছন থেকে বেঁধে ফেলেন অসীম। এ কাজে অসীমকে সহায়তা করেন মাসুদ। আনিসুলের ঘাড়ে কনুই দিয়ে আঘাত করেন সজীব। একইভাবে আনিসুলের ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করেন তানিফ, আনিসুলের মাথায় চেপেও বসেন তিনি। লিটন ও জোবায়ের আনিসুলের দুই পা চেপে ধরেন। পলাশ আনিসুলের শরীর চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর আনিসুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপর আর তার চেতনা ফেরেনি।
ওই কক্ষের সিসিটিভির একটি ফুটেজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেখানেও এই ঘটনাক্রম দেখা যায়। ভিডিওতে কিছুক্ষণ পর সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত একজন নারীকে ওই কক্ষে প্রবেশ করে আনিসুলকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দেখা যায়।