বাংলাদেশে যে আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটল, সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ফেইসবুক। আর তাই সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিজ্ঞাপনের আড়ালে রাজনৈতিক প্রচারও চলেছে এই সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে।
ফেইসবুকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেটার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করে ৬৫ লাখ ১১ হাজার টাকা আয় করেছে তারা। এরমধ্যে ৩০ জুলাই একদিনেই আয় হয় প্রায় ১২ লাখ টাকা।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে জুলাই মাসের শুরুতে কর্মসূচি পালন শুরু হলেও সেই আন্দোলন গতি পেয়েছিল ১৫ জুলাই।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালালে তা সংঘাতে গড়ায়। সরকার কঠোর হাতে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নিলে সহিংসতায় কয়েকশ মানুষ নিহত হওয়ার পর গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটে।
এই আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফেইসবুকসহ সোশাল মিডিয়া। ফেইসবুকে পুলিশের গুলিবর্ষণ, হত্যার ছবি-ভিডিও এলে তা দেখে সরকারের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটে। পতনের আগে আওয়ামী লীগ সরকার ইন্টারনেট, ফেইসবুক বন্ধ করলেও রক্ষা পায়নি।
মেটার অ্যাড লাইব্রেরি রিপোর্টে দেখা যায়, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেইসবুকে প্রায় ১ হাজারের মতো পেইজ থেকে রাজনৈতিক পোস্ট বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী উভয় ধরনের প্রচার চালানো হয়।
এর মধ্যে ১০০ ডলারের ওপরে বিজ্ঞাপন দেয় ৫৫টি পেইজ। এই পেইজগুলো থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক পোস্টের রিচ বাড়াতে ৫৪ হাজার ২৫৮ ডলার খরচ করা হয়। প্রতি ডলারের জন্য ১২০ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ১১ হাজার টাকার মতো।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলে এই ৫৫টি পেইজের ৪২টিই মুছে দেওয়া বা ডিলিট করে দেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যালোচনা ও পেইজগুলোর নাম থেকে বোঝা যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া পেইজগুলো থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রচার চালানো হচ্ছিলো।
এই বিজ্ঞাপনদাতাদের শীর্ষ ২০টি পেইজ থেকে প্রচার করা বিজ্ঞাপনগুলোর খরচ ছিল ৪৬ হাজার ৪৪৪ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই খরচ দাঁড়ায় ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ২৮০ টাকা।
বিজ্ঞাপনের খরচের দিক দিয়ে সবচেয়ে ওপরে থাকা পেইজ ‘ভালোর পথে’। আলোচিত ২১ দিনে এই পেইজ থেকে ২২০টি পোস্ট বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করতে ফেইসবুক নেয় ১১ হাজার ১১৪ ডলার।
এর পরেই আছে আহ্বান নামের একটি পেইজ। এই পেইজ থেকে আলোচিত ২১ দিনে ২১৮টি পোস্ট বুস্ট করতে ৬ হাজার ৬২৯ ডলার নেয় ফেইসবুক।
একইভাবে প্রেস এক্সপ্রেস পেইজ থেকে ১১৯টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৪ হাজার ২০১ ডলার, আমার দেশ আমার অহংকার পেইজ থেকে ৮০টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৩ হাজার ৭৬২ ডলার, আমারই বাংলাদেশ পেইজ থেকে ৭৩টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৩ হাজার ৩৮৪ ডলার, সিএপি- ক্যাম্পেইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম পেইজ থেকে ৭৯টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ২ হাজার ৪০৫ ডলার, প্রেসএক্সপ্রেস (প্রায় একই নামের দুটি পেইজ আছে) পেইজ থেকে ৫৪টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ২ হাজার ৩৭৯ ডলার, ক্রাইম স্টেশন পেইজ থেকে ৪৭টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ৭৯৯ ডলার ও অনস এগেইন শেখ হাসিনা পেইজ থেকে ৫৬টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ৭১৮ ডলার নেয় ফেইসবুক।
এছাড়া ইসলামের আলো পেইজ থেকে ৪১টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ৪৯০ ডলার, আবার দশ ট্রাক পেইজ থেকে ৩৯টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ২৩৫ ডলার, তারেক রহমান নামের পেইজ থেকে ৭টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ৭৮ ডলার, দুশমন পেইজ থেকে ৩৭টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১ হাজার ৩৬ ডলার, দুষ্ট কোকিল পেইজ থেকে ৪২টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৯১২ ডলার, এলিয়েন পেইজ থেকে ৪৪টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৬৭৪ ডলার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেইজ থেকে ১৬৫টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৬৭০ ডলার আয় করে ফেইসবুক।
অথেনটিক নিউজ পেইজ থেকে ১৭০টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৫৪৪ ডলার, পথ হারাবে না বাংলাদেশ পেইজ থেকে ১৭টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৫৪৩ ডলার, টিকটক নামের একটি পেইজ থেকে ২৫টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৪৯১ ডলার, ডেইলি নিউজ নামের একটি পেইজ থেকে ১৩৮টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৪৮০ ডলার আয় করে ফেইসবুক।
এই পেইজগুলোর মধ্যে এখন কেবল তারেক রহমান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেইজ দুটি সক্রিয় রয়েছে।
মেটার অ্যাড লাইব্রেরির রিপোর্ট অনুযায়ী, মূলত রাজনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত পোস্টের শেয়ার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পেইজগুলো। এই বিজ্ঞাপনগুলোর লোকেশন ছিল বাংলাদেশ।
সরকার পতনের আগে ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ অনেক এগিয়ে থাকলেও সরকার পতনের পর দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
গত ৮ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও বিএনপি মিডিয়া সেল নামের দুটি ভেরিফায়েড পেইজ থেকে ১২৪ ডলার খরচ করা হয়েছে। এই সময়ে আর কোনও পেইজ থেকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের জন্য কেউ ফেইসবুকে অর্থ খরচ করেনি।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের আগে-পরে
কোটা সম্পর্কিত হাইকোর্টের রায়ের ওপর আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা দেওয়ায় গত ১০ জুলাইয়ের পর থেকে অসন্তোষ বাড়ছিল। ১৮ জুলাই সহিংসতা ব্যাপক রূপ নিলে ওই দিন থেকে সকাল থেকে ফোর জি মোবাইল ইন্টারনেট এবং সন্ধ্যার পর সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার।
মেটার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ফেইসবুকে ১০০ ডলারের ওপর খরচ করে ১৬টি পেইজ থেকে রাজনৈতিক পোস্ট শেয়ার করা হয়েছিল। এজন্য বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ হয় ৩ হাজার ১২১ ডলার, যা প্রায় ৩ লাখ ৬ হাজার টাকার সমান।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকওয়াউটের সময়ে ১৯ থেকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে ফেইসবুকে বিজ্ঞাপনে মোট ব্যয় দেখা যায় ৪৮০ ডলারের এর মতো।
তবে জুলাইয়ের ২৩ তারিখ রাতে ইন্টারনেট সেবা ফিরে আসার পর জুলাই ২৪ থেকে শুরু হয় বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ ব্যয়ের জোয়ার।
তবে এই সময়েও মোবাইল ইন্টারনেট তখনও বন্ধ ছিল। একই সঙ্গে জনপ্রিয় সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইট ১০দিন ব্লক করা ছিল।
গত ২৪ থেকে ৩০ জুলাই এই সাত দিনে বাংলাদেশে ফেইসবুক বন্ধ থাকার পরও অনেকে ভিপিএন দিয়ে ঢুকছিলেন। তখনও বিজ্ঞাপন দিয়ে রাজনৈতিক পোস্টগুলোর শেয়ার বাড়ানোর চেষ্টা চলে।
এই সাত দিন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে ৩৩ হাজার ৯৯২ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪০ লাখ টাকা) ব্যয় করে বিজ্ঞাপনদাতারা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেইসবুকে ২৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে সরকারের পক্ষে বিজ্ঞাপনদাতাদের মোট ব্যয় ছিল ৪৮ হাজার ২৬৩ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫৮ লাখ টাকা।
অন্যদিকে সরকারবিরোধী বিজ্ঞাপনে ব্যয় হয় ১ হাজার ২৭২ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দেড় লাখ টাকার কিছু বেশি।
এই সময়ের মধ্যে ২৭৫টি অ্যাকটিভ বিজ্ঞাপনদাতার মধ্যে প্রায় ১৫০টিকে তাদের বিজ্ঞাপন ও পেইজের কনটেন্টের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক পরিচয় শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট ‘যাচাই’।
তারা জানায়, ফেইসবুকে প্রচারিত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোর ৮০ শতাংশের বেশি বিজ্ঞাপনে ছিল সরকারের পক্ষে কন্টেন্ট। সরকারি প্রতিনিধিরা যা বলছিলেন, সেসবই এসব পোস্টে উঠে আসে।
যাচাই দেখিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তি হিসাবে ফেইসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিলেন সালমান এফ রহমান ও জুনাইদ আহমেদ পলক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এবং সাবেক তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলক দুজনই সরকার পতনের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পোস্টগুলোর বিষয়বস্তু
ফেইসবুকে বুস্ট করা রাজনৈতিক পোস্টগুলোর বিষয়বস্তু ছিল- সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞে বিরোধী দল কীভাবে মদদ দিয়েছে এবং অংশ নিয়েছে; বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসাবশেষের চিত্র; আন্দোলনকারী ও তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক বিভিন্ন সহিংসতার বর্ণনা; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণের ঘটনা; আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান প্রভৃতি।
অন্যদিকে সরকারবিরোধী বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো হলেও তাদের বিজ্ঞাপন ব্যয় ছিল তুলনামূলক কম। কেবল বিএনপির অফিসিয়াল পেইজ ছাড়া অন্যান্য পেইজের বিজ্ঞাপন ব্যয় ছিল ১০০ ডলারেও কম।
সরকারবিরোধী পেইজের বিজ্ঞাপনগুলোর পোস্টে মূলত কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানানো হয় এবং সরকার কর্তৃক হতাহতের বিচার চাওয়া হয়।
সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে এমন পেইজগুলোর অ্যাডমিনদের লোকেশন অনুসন্ধান করে দেখা যায় অধিকাংশ এডমিন বাংলাদেশভিত্তিক। এ থেকে যাচাই’র ধারণা, এ সময়ে ফেইসবুক বন্ধ থাকলেও ভিপিএনের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছিল তারা।
তবে কোনও কোনও পেইজের একজন করে হলেও অ্যাডমিন বাইরের দেশ যেমন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে।
ধর্মীয় পেইজের আড়ালে রাজনৈতিক প্রচার
ধর্মীয় পেইজের আড়ালে রাজনৈতিক প্রচারের বিষয়টিও তুলে ধরেছে যাচাই।
তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসলামের আলো’ নামের একটি ফেইসবুক পেইজ সাধারণত ওয়াজ, কোরআন ও হাদিসের বাণী সম্বলিত পোস্ট ও বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
এই ধরনের পেইজ থেকে ২৭-৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ৫৫১ ডলার ব্যয় করে ২১টি বিজ্ঞাপন দেয়। ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, শায়েখ আহমাদুল্লাহ, শায়েখ আবু বকর যাকারিয়া, শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ এর মতো বিশিষ্ট ইসলামী বক্তাদের ওয়াজের অংশ বিশেষ এসব বিজ্ঞাপনে প্রচার করে।
বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু ছিল এমন- উগ্রবাদী কোনও আন্দোলন ইসলাম সমর্থন করে না; কোটা সংস্কার আন্দোলন ইসলাম কী বলে, জ্বালাও-পোড়াও দায়ভার কে নেবে; আপনি কি জানেন লাল রং শয়তানের রং হিসেবে বিবেচিত এবং লাল রং ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ; ফিতনায় পা দেবেন না; মিছিল করা ইসলামে জায়েজ নয়; রাস্তা অবরোধ করা জায়েজ কিনা এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা; হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে ইসলাম কী বলে; ইসলাম আর জামায়াতে ইসলাম কখনোই এক নয়।
এছাড়া প্রতিপক্ষের নাম ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়াতেও বিজ্ঞাপন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা যায় ‘রুহুল কবির রিজভী আহমেদ’ নামের একটি পেইজ থেকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে সরকারবিরোধী দুজনের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। এর হলেন নেত্র নিউজর প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের।
যাচাই বলছে, এ থেকে ধারণা করা যায় পেইজটি প্রকৃতভাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের দ্বারা পরিচালিত নয়।
গত বছর ওই পেইজ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি ডিপ ফেইক ভিডিও বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়, যেখানে নাশকতামূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে দলের নেতা কর্মীদের আহ্বান জানানো হয়। ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে সেটিকে ভুয়া বলে জানিয়েছিল যাচাই।
জেলাভিত্তিক পেইজ থেকেও বিজ্ঞাপন
পরিসংখ্যান ঘেঁটে অন্তত ৩৮টি পেইজ পাওয়া গেছে, যারা নিয়মিত জেলাভিত্তিক অরাজনৈতিক কন্টেন্ট প্রকাশ করে অডিয়েন্স তৈরি করেছে। এসব পেইজ থেকে গত ২ সপ্তাহ প্রায় একযোগে একই ধরনের রাজনৈতিক পোস্ট এবং বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে, যেগুলো সরকারের পক্ষে।
এসব পেইজের মধ্যে রয়েছে সোনালী সাতক্ষীরা, বগুড়া বার্তা, প্রাণের নওগাঁ, ইছামতির কথন, মহানন্দা জনপদ, ময়মনসিংহের আলো ও শেরপুরের দর্পণ।
২০২২ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে ব্যয়
মেটা অ্যাড লাইব্রেরির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১৪ হাজার ২০১টি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার হয় ফেইসবুকে।
এর মধ্যে মাত্র ৫টি পেইজ থেকে গত ২৪ জুলাই থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ১৩ হাজার ৭৭৫ ডলারের বিজ্ঞাপন পেয়েছে ফেইসবুক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
শীর্ষ ২০ পেইজের তালিকায় রয়েছে প্রেস এক্সপ্রেস। এই পেইজ থেকে ৩ হাজার ৮৭২টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ফেইসবুক আয় করেছে ২৭ হাজার ৩৯ ডলার।
এর পরেই রয়েছে ভালোর পথে পেইজ। এই পেইজটি থেকে ২ হাজার ৬৫টি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ফেইসবুককে দিতে হয় ২৭ হাজার ৯৭৫ ডলার।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সালমান এফ রহমানের পেইজ। এই পেইজ থেকে ৭০৭টি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এ থেকে ফেইসবুক আয় করে ২৬ হাজার ৮৬৩ ডলার।
জুনাইদ আহমেদ পলকের পেইজ থেকে ৪৯১টি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ফেইসবুক নেয় ২৫ হাজার ৬০৭ ডলার।
রূপগঞ্জের কথা পেইজ থেকে ৯৬টি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ফেইসবুককে দিতে হয় ২৫ হাজার ২১১ ডলার।
সিএপি-ক্যাম্পোইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম নামের একটি পেইজ থেকে ৬৩৭টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এ থেকে ফেইসবুক আয় করে ১২ হাজার ৮৭৯ ডলার।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি-বিএনপির ফেইসবুক পেইজ থেকে ৪২টি বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করা হয় ১২ হাজার ৩৬১ ডলার।
এছাড়া আহ্বান পেইজ থেকে ১,৮৬৫টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১২ হাজার ২০৫ ডলার, বিডি পিপুল ভয়েস পেইজ থেকে ৪২৭টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১১ হাজার ৯২৪ ডলার, বিএনপি মিডিয়া সেল পেইজ থেকে ১০৬টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১০ হাজার ৭৭৫ ডলার, এম এ রাজ্জাক খান রাজ সিআইপি পেইজ থেকে ৩৬৩টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ১০ হাজার ৭০৭ ডলার, সফল বাংলাদেশ পেইজ থেকে ৩,২৪১টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৯ হাজার ৩৫৯ ডলার, আমার নেত্রী আমার অহংকার পেইজ থেকে ২,৮০০ বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৯ হাজার ৭৭ ডলার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেইজ থেকে ২,৭২৩টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৯ হাজার ৬১ ডলার, প্রজন্মের আওয়াজ পেইজ থেকে ১,৬৬৮টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৮ হাজার ৭২৩ ডলার, সালমা ইসলাম-এমপি পেইজ থেকে ৫০টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৮ হাজার ৫৪৩ ডলার, মাহমুদ হাসান রিপন নামের পেইজ থেকে ২৭১টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৭ হাজার ৬৯৭ ডলার, পজিটিভ বাংলাদেশ পেইজ থেকে ১,৬০৬টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৭ হাজার ২৯৯ ডলার, বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভ পেইজ থেকে ২,০০০টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৭ হাজার ৩৭ ডলার এবং এটুআই অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট পেইজ থেকে ১১২টি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ৬ হাজার ৩২৪ ডলার আয় করে ফেইসবুক।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা ফেইসবুক পেইজগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে রাজনীতি, আবিজা, গো বাংলাদেশ, নাশকতা, আগামীর বাংলাদেশ, দাদু ভাই, প্ল্যাটফর্ম ফর ডায়ালগ, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা, অপরাজেয় বাংলাদেশ, সেই রাজাকার এই রাজাকার, ষড়যন্ত্রের আড়ালে, শেখ হাসিনাতেই আস্থা, রুখে দাও ষড়যন্ত্র, প্রজন্ম বাংলাদেশ ইত্যাদি।