Beta
রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আনার : কোন পথ পেরিয়ে রাজনীতিতে

আনোয়ারুল আজীম আনার।
আনোয়ারুল আজীম আনার।
[publishpress_authors_box]

ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার আনোয়ারুল আজীম আনার রাজনীতিতে নেমে সংসদ সদস্য হওয়ার আগে যে পথ পেরিয়ে এসেছিলেন, যা একইসঙ্গে সমালোচিত ও বিতর্কিত।

কৈশোরে স্থানীয় ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। অল্প বয়সে যথেষ্ট নাম করলেও ফুটবল ধরে থাকেননি। যুবক বয়সে জড়িয়ে পড়েন চোরাচালানে, তারপরই নামেন রাজনীতির মাঠে।

অর্থ ও প্রভাব বলয়ে ৫৬ বছর বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঝিনাইদহের রাজনীতিতে প্রতাপশালী। পৌর কাউন্সিলর, পৌর চেয়ারম্যান হওয়ার পর ২০১৪ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে এবার নির্বাচিত হন তিনি। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিলেন তিনি।

গত দুই যুগ ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতাপ থাকলেও তার আগে রাজনীতিতে তার সক্রিয়তার খবর তেমন মেলে না।

তার বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। সেখানে মাছ বাজার ও হলুদের হাট নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি সীমান্তের ওই জেলায় চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন আনার, এমনটা তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।

তাদের একজন বলেন, “অনেকটা প্রকাশ্যেই তিনি (আনার) ভিসিপি ও ভিসিআর চোরাচালান করতেন। তখন মাদক কারবারেও তার নাম জড়িয়েছে অনেকবার। অল্প বয়সেই কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও জীবননগর এলাকার চোরাচালান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেন আনার।”

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চোরাচালানের কারবার বজায় রাখতে আনার সখ্য গড়ে তোলেন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। তবে এ সখ্য দীর্ঘ হয়নি।

তৎকালীন বিএনপি নেতা ও পরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন আনার। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হলে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ অঞ্চলের এক সময়ের চরমপন্থি নেতা আমিনুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে আনারের সখ্যের কথাও জানা যায় স্থানীয়দের কাছে।

১৯৯৫ সালে আবদুল মান্নান বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে আনারও দলবদল করেন। ওই আসনে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন বিএনপির শহীদুজ্জামান বেল্টু। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতেন আওয়ামী লীগের মান্নান।

বিএনপি আমলে কিছুটা বিপাকে পড়েন আনার। অস্ত্র, স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি পালিয়ে যান ভারতে। এবার ভারত গিয়ে যে গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেছিলেন, তার সঙ্গে তখনই পরিচয়, যা গোপালের ভাষ্যে জানা যায়।

আনারের ২৪ বছর বয়সী মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের কথাও জানা যায়, পালিয়ে থাকায় ছোটবেলায় বাবাকে কাছে পাননি তারা। তবে পরিবারের দাবি, ওই সব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০০৪ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে দেশে ফেরেন আনার। তখনও তার নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিস ঝুলছিল। অস্ত্র ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি হিসেবে তাকে খোঁজাও হচ্ছিল।

জরুরি অবস্থা জারির পর ২০০৮ সালে ঝিনাইদহের আসনটিতে মান্নান সংসদ সদস্য হলেও আনারের প্রভাব বাড়তে থাকে। কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। রাজনৈতিক বিবেচনায় তার বিরুদ্ধে মামলাগুলোও প্রত্যাহার হতে থাকে।

এদিকে আনারের প্রভাব বাড়তে থাকায় কোনঠাসা হয়ে পড়েন মান্নান। কালীগঞ্জে রাজনৈতিক দলের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে হাট-ঘাট ইজারাসহ সব কাজ চলতে থাকে আনারের নির্দেশনায়।

২০১৪ সালে মান্নানকে হটিয়ে আনারই সংসদ সদস্য হন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার জমা দেওয়া হলফনামাও তার বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেকার মামলাগুলোর সাক্ষ্য বহন করে।

অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ বিশ্বাস কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে আত্মগোপন করা অবস্থায় তার মাধ্যমে চোরাকারবারে চক্র গড়ে তোলেন আনার। স্বর্ণ চোরাকারবারে তার সক্রিয়তার কথা পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে জানান কথা স্বীকার করেন। তবে তারা কেউ মুখ খুলতে রাজি নন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, বিএ পাস আনারের স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে সম্পদ অন্তত ৪ কোটি টাকার।

তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানান, রাজনীতিতে নামার পর জনসংযোগ বাড়াতে প্রায় প্রতিদিন আনার মিলাদ, জানাজাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। নির্বাচনী এলাকায় এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে তিনি যাননি।

এমনকি নিজে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাশ পৌঁছে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। পাশাপাশি নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনেও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সরাসরি। এসব মিলিয়ে তার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না।

ঝিনাইদহ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠু মালিথা বলেন, “আনার ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ।”

জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে আনারকে কারা হত্যা করেছে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার খুনের খবর নিশ্চিত করলেও লাশ এখনও পাওয়া যায়নি বলেই জানিয়েছে ভারতীয় পুলিশ।

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সকাল সন্ধ্যার আঞ্চলিক প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম]

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত