মহাকাশে সময় কাটানো এবং সেখান থেকে পৃথিবীর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার স্বপ্ন অনেকেই দেখে থাকেন।
তবে মানবদেহের গঠন ও কার্যকারিতা যেহেতু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিবর্তিত হয়েছে, তাই মহাকাশে ওজনহীনতার মধ্যে দীর্ঘসময় থাকলে মানবদেহে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেখান থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
আট দিনের জন্য মহাকাশে গিয়ে ৯ মাস সেখানে থাকতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে। সঙ্গে ছিলেন নিক হেইগ ও ডন পেটিট নামে আরও দুজন মহাকাশ অভিযাত্রী।
মহাকাশযানে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে নভোযানে আটকে পড়া এই নভোচারীরা গত মঙ্গলবার সকালে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই এমন জায়গায় টানা ২৮৬ দিন থাকার ফলে দেহে যে প্রভাব পড়েছে, তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করতে হবে সুনিতাদের।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে মানব দেহতত্ত্বের অধ্যাপক ড্যামিয়ান বেইলি বলেন, “মানুষ যত ধরনের পরিবেশের সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে মহাকাশ সবচেয়ে কঠিন জায়গা। এই কঠিন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো করে আমাদের শরীর তৈরি হয়নি।”
মহাকাশে গেলে মানুষের শরীরে যে পরিবর্তন আসে, শুরুর দিকে তা ভালোই লাগে বলে জানান নভোচারী টিম পিক। ২০১৫ সালে মহাকাশ অভিযানে বেরিয়েছিলেন তিনি।
টিম পিক বলেন, “মহাকাশ শুরুতে ছুটির দিনের আমেজ দেয়। হৃৎপিণ্ড, মাংসপেশী ও হাড়ের তখন কাজ করা সহজ হয়। চমৎকার শূন্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির পরিবেশে ভেসে বেড়াতে দারুণ লাগে।”
কয়েক সপ্তাহ ধরে কেউ বিছানায় শুয়ে আছেন, ওঠার নামগন্ধ নেই; একটা সময় পর তার কেমন লাগবে? এই বোঝাপড়া থেকেই বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেন, শূন্য মাধ্যাকর্ষণ ওই ব্যক্তির দেহে ঠিক কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
পেশী শক্তি
পেশীর ব্যবহার নিয়মিত করা না হলে এটির শক্তি হারানোর শঙ্কা থাকে। স্থির হয়ে দাঁড়ানোর মতো সহজ কাজেও সারা শরীরের পেশী ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু মহাকাশে পেশী শক্তির ব্যবহার হয় না। যেখানে কোনও কিছুরই ভর নেই, সেখানে পেশী শক্তির ধারণাটাই যায় পাল্টে।
ত্বরান্বিত বার্ধক্য
হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালীর জন্যও মহাকাশে কাজ করা সহজ হয়ে যায়, কারণ তাদের আর মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে রক্ত পাম্প করা লাগে না। এতে তারা দুর্বল হতে শুরু করে। একই সঙ্গে হাড় দুর্বল ও আরও ভঙ্গুর হতে থাকে।
তাই পুরনো হাড় ভাঙা ও নতুন হাড় তৈরির কোষগুলোর মধ্যে ভারসাম্য থাকা দরকার। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ ছাড়া সেই ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক বেইলি বলেন, “প্রতি মাসে নভোচারীদের হাড় ও পেশী প্রায় এক শতাংশ করে ক্ষয় হতে থাকে। এটা বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে।”
পৃথিবীতে ফিরে আসার পরই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৯ মাস মহাকাশে থাকার পর মঙ্গলবার ফ্লোরিডার উপকূলে অবতরণ করেন সুনিতাসহ চার নভোচারী।
তাদের অবতরণের ভিডিও ধারণ করে নাসা। তাতে দেখা যায়, মহাকাশচারীদের ক্যাপসুল থেকে বের করে স্ট্রেচারে তুলতে সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে।
সুনিতাদের এখন তাদের হারানো কার্যকারিতা ফিরে পেতে ভারী ব্যায়াম করতে হবে।
মহাকাশে যাওয়া প্রথম ব্রিটিশ ড. হেলেন শারম্যান বলেন, “সুনিতাদের পেশীর ভর তৈরি করতে সম্ভবত কয়েক মাস সময় লাগবে।”
তিনি জানান, নভোচারীদের হাড়ের ভর ফিরে পেতে হয়তো কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে পৃথিবীতে ফেরার পর হাড়ের পুনর্গঠনের সময় এমন কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যা হয়তো পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফেরে না।
তবে শুধু পেশী বা হাড় নয়, পুরো শরীরকেই বদলে দেয় মহাকাশ। এমনকি মানবদেহে বাস করা ভালো ব্যাকটেরিয়ার ধরনও বদলে যায়।
এছাড়া মুখে ফোলাভাব নভোচারীদের শরীরে প্রথম লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলোর একটি।
এটি মস্তিষ্কে ফোলাভাব ও চোখেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যার মধ্যে অপটিক নার্ভ, রেটিনা, এমনকি চোখের আকৃতিও অন্তর্ভুক্ত।
মাথা ঘোরানো
শূন্য মাধ্যাকর্ষণ দেহের ভেস্টিবুলার সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটায়। এই সিস্টেম ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
নভোচারী টিম পিক বলেন, “মাথা ঘোরা বন্ধ, ভারসাম্য ও স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলার শক্তি ফিরে পেতে নভোচারীদের ২-৩ দিন সময় লাগে।
“পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রথম ২-৩ দিন সত্যিই তাদের জন্য কষ্টকর।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি