আমাদের জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ই কাটে বিছানা আর বালিশে!
হিসাবটা সহজ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়া, ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে আবার সেই বিছানায় ঝাঁপ। মাথা পেতে দেওয়া বালিশে। এইতো বেশিরভাগের জীবন। বিছানা-বালিশের জীবন!
তবে বিছানাজুড়ে যে কেবল আমাদেরই বাস তা কিন্তু নয়। ওখানে বাসা বাঁধে কিছু অদেখা প্রতিবেশী !
কিন্তু কারা এই প্রতিবেশী ? আবার অদেখা?
আপনি জেনে হয়তো আঁতকেই উঠবেন। বিছানায় আপনার এই প্রতিবেশীরা হলো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, খালি চোখে দেখা যায়না এমন কিছু অনুজীব যাদের বলা হয় মাইট এবং ভাইরাস। আপনার বিছানার চাদর এবং বালিশেই এদের বাস। কারণ আপনার বিছানার চাদর আর বালিশ যে এদের খাবারে ভরপুর!
আর এই খাবারের উৎস হলেন আপনি নিজেই! শরীরের মৃত কোষ, ঘাম আর লালায় ভরপুর আপনারই বিছানার চাদর-বালিশ যে এই প্রতিবেশীদের বেঁচে-বর্তে থাকার উৎকৃষ্ট স্থান।
আমাদের শরীর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মৃত কোষ ঝরে যায়। বিছানার চাদরে বাসা বাঁধা মাইটদের যেগুলো ভীষণ প্রিয় খাবার। এছাড়াও আলগা উপদ্রব হিসেবে কারও কারও বিছানায় হাজির হয় ছারপোকা, যাদের মল আবার মানুষের অ্যাজমা, অ্যালার্জি এবং একজিমা বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে ব্যাকটেরিয়া যে কেবল বিছানা চাদরেই থাকে এমন নয়। এরা বসবাস করে আমাদের ত্বকেও।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানাল মোহাম্মদ বলেন, “যদিও এ ব্যাকটেরিয়া সাধারণত কোন ক্ষতি করেনা, তবে ত্বকের ক্ষত স্থান দিয়ে শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তখন সেগুলো গুরুতর অসুস্থতার কারণ হতে পারে। হাসপাতালে যা প্রায়ই ঘটে।”
২০১৮ সালে নাজেরিয়ার ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা হাসপাতালের পরিষ্কার করা হয়নি এমন বিছানার চাদর পরীক্ষা করে ইকোলাই ভাইরাস খুঁজে পেয়েছিলেন। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার জন্য দায়ী এমন ব্যাকটেরিয়াও ওই চাদরে ছিল।
২০০৬ সালে গবেষক ডেনিং তার সহকর্মীদের নিয়ে ব্যবহৃত বালিশের ওপর এক পরীক্ষা চালায়। যেই বালিশগুলো ১৮ থেকে ২০ মাস ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরীক্ষায় সব বালিশেই এমন ধরনের ছত্রাক পাওয়া গিয়েছিল যেগুলো মাটিতেও পাওয়া যায়।
প্রতিটি বালিশে কী পরিমাণ ছত্রাক পাওয়া গিয়েছিল তা জানলে যে কারও মাথা ঘুরে যেতে পেতে পারে।
বিলিয়ন তো বটেই, কোন কোনটাতে ট্রিলিয়নও!
ওই গবেষণার ফল নিয়ে ডেনিং বলেন, “এই পরিমাণ ছত্রাক কেন পাওয়া গেল তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা বের করলাম, রাতে ঘুমানোর সময় আমাদের বেশিরভাগেরই মাথা ঘামায়। তাছাড়া বিছানার চাদরে থাকা মাইট তো আছেই। যাদের মল ছত্রাকের খাবার। ঘাম-টাম সব মিলিয়ে ছত্রাকের জন্য অনুকূল এক পরিবেশ।”
বালিশ আমাদের খুব কমই পরিষ্কার করা হয়। ফলে ছত্রাক বেশ নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠতে পারে বালিশে। ছত্রাকগুলো একমাত্র তখনই বিপদে পড়ে যায় যখন বালিশের তুলো বের করে নেড়েচেড়ে দেওয়া হয় অথবা বালিশ রোদে দেওয়া হয়। এ সময় আবার বাতাসে ছত্রাকের রেনু ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বালিশ লন্ড্রিতে দিয়েও যে ছত্রাক একেবারে সাফ করে দেওয়া যায় তা কিন্তু নয়। কারণ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১২২ ফারেনহাইট) বেশি তাপমাত্রাতেও ছত্রাক বেঁচে থাকতে পারে। আবার বালিশ ধুলেই যে ছত্রাক চলে যাবে তা নয়। কারণ ভেজা বালিশের আর্দ্রতা উলটো ছত্রাকের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
মানুষের ঘুমানোর সময়সীমা এবং বালিশের সঙ্গে মুখের নৈকট্য, ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গবেষণা চালিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মারাত্মক কিছু ফলাফল পেয়েছেন। এতে দেখা গেছে, বিশেষ করে শ্বাসনালীর রোগ, যেমন হাঁপানি এবং সাইনোসাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বালিশে থাকা ছত্রাক মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যারা অতীতে টিবি অথবা ধুমপান জনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন তারা ভুগতে পারেন দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের অসুখে।
ডেনিং এর মতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো এমন ৯৯ শতাংশ মানুষ এসপারগিলাস ফিউমিগ্যাটাস ধরনের ছত্রাকের রেণুর সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারলেও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষদের ক্ষেত্রে, ছত্রাক প্রাণনাশের কারণ হতে পারে।
তাহলে বালিশ পরিষ্কার করেও যদি কাজ না হয় তবে উপায় কী?
ডেনিং এর মতে, যদি কারও অ্যাজমা, ফুসফুসের রোগ অথবা সাইনাস না থেকে থাকে তবে বালিশ দুই বছর অন্তর পাল্টালেও চলবে। তবে যারা এইসব সমস্যায় ভুগছেন, তাদের তিন থেকে ছয় মাস অন্তর পুরোনো বালিশ ফেলে দিয়ে নতুন বালিশ কেনা উচিত।
এ-তো গেল বালিশের আলাপ। আর বিছানার চাদর?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিছানার চাদর সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করা উচিত। শুধু পরিষ্কারই নয়, একই সঙ্গে আয়রন করলে চাদরে থাকা ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পায়।
ডেনিং বলেন, “কিছুই করার না থাকলে বিছানার চাদর আয়রন করে সময় কাটান, মনে রাখতে হবে আমাদের সবার শরীরেই কিন্তু ব্যাকটেরিয়া আছে, তাই তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
ডেনিং আরও বলেন, “তবে আপনি যদি অসুস্থ আর দুর্বল হন, তবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার বাসায় ছোট্ট শিশু থাকে তবে আপনাকে সাবধান হতেই হবে। উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে বিছানার চাদর।”
বিছানায় পোষা প্রাণী নিয়মিত ঘুমালে চাদরে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের পরিমাণ বাড়তে পারে। গোসল না করে রাতে বিছানায় শুয়ে পড়ার অভ্যাস, নোংরা মোজা পড়ে ঘুমানো, শরীরে লোশন মেখে ঘুমোতে যাওয়া এবং বিছানায় খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস চাদরে এবং বালিশে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক বাড়তে সহায়তা করে।
ডেনিং বলছেন, “আমি বলছি না বিছানায় বসে খাওয়াই যাবেনা। ব্যাপারটা হলো, এমন অভ্যাস থাকলে অতি অবশ্যই নিয়মিত চাদর পরিষ্কার করতে হবে। আমার মনে হয়, সেক্ষেত্রে সপ্তাহে মাত্র একবার যথেষ্ট নয়।”
বিবিসি অবলম্বনে