জীবন রক্ষাকারী উপাদান ওষুধ। শরীরে ব্যাধি বাসা বাঁধলে সবাই এই উপাদান কিনতে ছোটে। অথচ জীবনধারণে অত্যন্ত জরুরি এই পণ্য অপচয় হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে একদিকে ওষুধের অপব্যবহার বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপচয়। এই অপচয় রোধে কোনও উদ্যোগ নেই। আইন নেই।
ওষুধ অপচয়ের জন্য মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা। তবে এর সঙ্গে ওষুধ উৎপাদকদেরও দায়ী করা হচ্ছে।
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা মশিউর রহমান। মা-বোনের সঙ্গে থাকেন। বলতে গেলে সারা বছরই অসুখ-বিসুখে ভোগেন তারা। নিয়ম করে ওষুধ কেনেন মশিউর এবং তা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই।
কষ্টার্জিত অর্থ মশিউর ওষুধের পেছনে খরচ করলেও বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়ে ওঠে না। পড়ে থাকে টেবিলের দেরাজে বা এখানে-সেখানে। গত ছয় মাসে তার ঘরে অব্যবহৃত ওষুধ জমেছে প্রায় হাজার টাকার।
মশিউর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রায় সময়ই আমার বাসার কারও না কারও জ্বর, অ্যাসিডিটি বা পেট খারাপ হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মা বা বোন, কখনও আমি নিজেই ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে আনি।
“বেশিরভাগ সময় একপাতা ওষুধ কেনা হয়। কিন্তু ২-৪টি ট্যাবলেট খাওয়ার পরই দেখা যায় শারীরিক সমস্যাটি আর নেই। সুস্থ হয়ে গেছে রোগী। তখন ওই পাতার বাকি ওষুধগুলো ড্রয়ারে বা যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।
“এভাবে একটা সময় পর ওষুধের মোড়ক নষ্ট হয়ে যায়। পরে কারও একই সমস্যা দেখা দিলে সেই ওষুধ আর খাওয়া হয় না। নতুন করে ওষুধ কিনতে হয়।”
এত গেল রোগী বা তার স্বজনদের চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কেনা ও খাওয়ার প্রবণতা এবং সুস্থ হয়ে ওঠার পর সে ওষুধের অপচয় কীভাবে হয়, তার চিত্র। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খেয়েও যে দেদারছে এর অপচয় হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়।
যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপার এলাকার বাসিন্দা জাহিদুস সামাদ মৃধা জানান, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কেনার পর বেশিরভাগ সময়ই কোর্স কমপ্লিট করা হয় না। চিকিৎসক ৭ দিন ওষুধ খেতে বলেছেন কিন্তু রোগী পঞ্চম দিনেই সুস্থ হয়ে গেছেন। তখন তিনি আর বাকি ওষুধগুলো খেতে চান না। সে ওষুধ ঘরে জমতে থাকে।
আবার যারা সময় ধরে ওষুধ খেতে ভুলে যান, তাদের ওষুধগুলোও এভাবেই নষ্ট হয়।
স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকার সাভারের শ্যামলাসী এলাকায় থাকেন হাসান আলী। তিনি বলেন, “আমার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় পড়ে। তখন ওষুধ কিনতে হয়। সেসব ওষুধের অধিকাংশই ব্যবহার করা হয় না, বাড়িতেই পড়ে থাকে।”
বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের ওষুধ বেশি অপচয় হয় দাবি করে হাসান আলী বলেন, “আমার বাড়িতে সবচেয়ে বেশি অপচয় হয় বাচ্চাদের সিরাপ। তাদের জন্য কেনা সিরাপের অর্ধেকই নষ্ট হয়।
“বড়দের জন্য ওষুধ কিনলে তা ভালোভাবে রাখলে কিছুদিন পর আবার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু শিশুদের সিরাপ একবার খোলার পর সেটা আর পরে ব্যবহার করা যায় না। ঘরের টেবিলের ওপর নয়তো ড্রয়ার খুললেই সেসব ওষুধ পাওয়া যায়। এভাবে দীর্ঘদিন পরে থেকে একসময় সেগুলোর ঠাঁই হয় ডাস্টবিনে।”
অবশ্য ফার্মেসি মালিকদের দাবি, মোড়ক ঠিক থাকলে এবং মেয়াদ না পেরোলে বিক্রিত ওষুধ ফেরত নেন তারা।
মোহাম্মদপুরের বসিলার মদিনা ফার্মেসির মালিক সোলাইমান মিয়া বলেন, “আমরা সাধারণত প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ফেরত নেই। তবে ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো জটিল রোগের বিক্রি হয়ে যাওয়া ওষুধ ফেরত নেওয়া হয় না। কারণ এসব ওষুধের দাম বেশি, বিক্রিও অনেক কম হয়।”
ঢাকার খিলগাঁওয়ের গোড়ান বাজার এলাকার খিলগাঁও ড্রাগস ফার্মেসির মালিক মো. সিরাজ বলেন, “আমার দোকান থেকে কেনা ওষুধ হলে আমি ফেরত নিই। তবে বিক্রিত ওষুধ ফেরত দিতে কাস্টমাররা খুব একটা আসেন না। কেবল অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিয়ে মাঝেমধ্যে আসেন দুয়েকজন। ওষুধের প্যাকেট নষ্ট না হলে ও মেয়াদ ঠিক থাকলে আমরা সাধারণত সেগুলো ফেরত নিই।”
“তবে অন্য ফার্মেসি থেকে কেনা ওষুধ আমরা ফেরত নেই না। অনেক ওষুধ ভেজাল হয়। তাই আমরা ঝুঁকি নিতে চাই না,” বলেন তিনি।
সিরাপ, ইঞ্জেকশনসহ তরল ওষুধ ফেরত নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার শাহ আলম ড্রাগ হাউজের মালিক মো. শাহ আলম। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “সিরাপের বোতলের ক্যাপ খোলার নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
“তবে ক্যাপসুল জাতীয় অব্যবহৃত ওষুধের মোড়ক ঠিক থাকলে ও মেয়াদ থাকলে ফেরত নেওয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষ ওষুধ কিনে বাসায় নেওয়ার পর যেখানে সেখানে ফেলে রাখেন। ঠিকমতো সংরক্ষণ করেন না। এতে ওষুধের মোড়ক নষ্ট হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ফেরত নেওয়া হয় না।”
এভাবে কী পরিমাণ ওষুধ নষ্ট হচ্ছে, তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে কত কিছুর পরিসংখ্যান হয়, গবেষণা হয়। কিন্তু ওষুধ অপচয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কোনও পরিসংখ্যান বা গবেষণা নেই। আর এই অপচয় বন্ধেরও কোনও উদ্যোগ দেখি না।
“অথচ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হলে অপচয় অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। আমার ধারণা, দেশে এমন কোনও পরিবার নেই, যেখানে ওষুধের অপচয় হয় না।”
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন না করার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, “একজন চিকিৎসক রোগীকে বলে দেন, কোন ওষুধ কতদিন ধরে কয়টি খেতে হবে। ওষুধ কেনার সময় সেই হিসাবমতো ওষুধ কিনে নিয়ম করে খেলেই কিন্তু আর অপচয় হয় না। কিন্তু বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসকের পরামর্শ মানেন না।
“ধরেন, ইনফেকশনের জন্য একজন চিকিৎসক একটি ওষুধ ৭ দিন খেতে বলেছেন। রোগী ওষুধ কেনার সময় ৭ দিনেরই কেনেন। কিন্তু সেই ওষুধ ৩-৪দিন খাওয়ার পর যখন ইনফেকশন ভালোর দিকে যায়, তখন রোগী ওষুধটি খাওয়া বাদ দিয়ে দেন। এটা একেবারেই ঠিক নয়। এতে ওই রোগীর দেহে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়।”
অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধের দাম অনেক কম উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এখনও আমরা ওষুধের পেটেন্ট বিনামূল্যে পাচ্ছি। কিছুদিন পর যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশ হব, তখন কিন্তু এই সুবিধা আর থাকবে না। ওষুধের মূল্য সেসময় অনেক বেড়ে যাবে। সেজন্য এ বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।”
তবে ওষুধ অপচয়ে মানুষের অসচেতনতাকে একমাত্র কারণ হিসেবে দেখছেন না বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক জ্যেষ্ঠ সভাপতি আব্দুল হাই। অপচয়ের জন্য ওষুধ উৎপাদকদেরও দায়ী করেন তিনি।
আব্দুল হাই বলেন, “অব্যবহৃত ওষুধ ক্রেতাদের কাছ থেকে ফেরত নিতে ফার্মেসি মালিকদের আপত্তি থাকে না। কিন্তু এসব ওষুধ যখন বিক্রি হবে না, মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তখন সেগুলো উৎপাদকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু তারা তা করেন না।
“প্রতিটি ফার্মেসিতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অবিক্রিত ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেখানে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। এসব ওষুধের যখন কোনও গতি করতে পারছি না, তখন বিক্রিত ওষুধ ফেরত নিয়ে কী করব আমরা? ফার্মেসিতে পড়ে থেকে তো নষ্টই হচ্ছে সেগুলো।”
কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক জ্যেষ্ঠ সভাপতি আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে অবশ্য একমত নন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রধান কার্যালয়) মো. আসরাফ হোসেন। তিনিও মনে করেন, মানুষের অসচেতনতাই ওষুধ অপচয়ের জন্য দায়ী।
আসরাফ হোসেন বলেন, “চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কারোরই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু অনেকেই তা করেন। আবার কেউ কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পর তা মানেন না। চিকিৎসক হয়তো ৭ দিন ওষুধ খেতে বলেছেন, রোগী খাচ্ছেন ৫ দিন। এটা ঠিক নয়।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, “ওষুধের বিষয়ে আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কিন্তু এর অপচয় রোধে তো কোনও আইন নেই। আর বিক্রিত ওষুধ ফেরত নিতে ফার্মেসি মালিকরা বাধ্য নন। তাই এ বিষয়ে আমরা কিছু করতেও পারি না। ওষুধের অপচয় রোধ করতে হলে মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হবে, যা সম্ভব নয়।
“তবে আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করি। এসব কর্মসূচিতে ওষুধের ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা হয়। সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই ওষুধের অপচয় রোধ করা সম্ভব।”
ওষুধ অপচয় সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) উপপরিচালক ডা. তউহীদ আহমদ বলেন, “দেশে কী পরিমাণ ওষুধের অপচয় হয়, এ নিয়ে কোনও গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। খুবই সীমিত সম্পদের দেশ বাংলাদেশ। ওষুধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনরক্ষাকারী উপাদানের অপচয় খুবই দুঃখজনক।”
ওষুধ অপচয়ের মূল কারণ হিসেবে মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করেন এই চিকিৎসক। বলেন, “আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ ওষুধের ব্যবহার নিয়ে খুবই অসচেতন। কেবল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিতরাই নন, শিক্ষিতরাও এ বিষয়ে বেশ উদাসীন। তাই ওষুধের অদরকারি ও নিয়মবহির্ভূত ব্যবহার সমাজের সব স্তরেই লক্ষণীয়।”
সিএমএসডির উপপরিচালক ডা. তউহীদ আহমদ বলেন, “আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, ওষুধ ইচ্ছেমতো খাওয়ার জিনিস নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনে এটি খেতে হয়।
“লোকজন তা না করে মুড়ি মুড়কির মতো ওষুধ কিনছে, খাচ্ছে। অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ না মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কোর্স শেষ করে না। এতে শুধু ওষুধের অপচয়ই হচ্ছে না, তাদের নিজেদেরও ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতন হওয়া জরুরি।”