ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক সমাবেশে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জম্মু ও কাশ্মীরে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কাশ্মীর হবে এমন এক অঞ্চল, যা শুধু সন্ত্রাসমুক্তই নয়, বরং পর্যটকদের জন্য হবে এক স্বর্গভূমি।
যে আশার বেলুন মোদী ফুলিয়েছিলেন, সাত মাস গড়াতেই তা পড়ল চুপসে, ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ খ্যাত পহেলগামে হামলার মধ্য দিয়ে।
গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে একদল সশস্ত্র হামলাকারী ২৫ জন পর্যটক ও একজন স্থানীয় খচ্চর চালককে হত্যা করে। এই ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ভারত হামলা নিয়ে পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে; যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে।
এই ঘটনার পর টানা তিন দিন ধরে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের সেনারা তাদের বিতর্কিত সীমান্তে গোলাগুলি চালিয়েছে। ভারত পহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে। পাকিস্তান হুমকি দিয়েছে, অতীতের শান্তিচুক্তিগুলো থেকেও তারা সরে আসতে পারে। পাশাপাশি দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও শত শত নাগরিককে বহিষ্কার করেছে।
তবে ভারত শুধু সীমান্তেই নয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত-শাসিত কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনী এখন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের পরিবারের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। তারা শত শত সন্দেহভাজনের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে এবং পহেলগাম হামলার পর থেকে দেড় হাজারের বেশি কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করেছে। পর্যটকদের ওপর গত ২৫ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা।
এদিকে নিরাপত্তা বাহিনী এখনো পাহাড় ও জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে হামলাকারীদের ধরার জন্য। হামলাকারীরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কাশ্মীর পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাশ্মীর নীতি নিয়ে বড় ধরনের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। তাদের মতে, এই নীতি এখন এক অচল অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় জাতীয়তাবাদ ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করা রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন্ত্র বোস বলেন, পহেলগামের এই হামলা ‘নতুন কাশ্মীর’ প্রতিষ্ঠার যে আওয়াজ ছিল, তাতে বড়সড় ফুটো তৈরি করেছে।
পর্যটকরা যখন টার্গেট
২০১৯ সালের আগস্টে ভারতের মোদী সরকার কোনও আলোচনা বা মতামত ছাড়াই কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে দেয়। এই বিশেষ মর্যাদা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কাশ্মীরের ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল।
মোদী সরকারের যুক্তি ছিল, পরপর যেসব সরকার এসেছে, তারা কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে একীভূত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতে, এই আধা-স্বায়ত্তশাসিত অবস্থান কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালানো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোর হাতে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
কাশ্মীরের জন্য সংবিধানে নির্ধারিত যে বিশেষ ধারা ছিল, সেটি বাতিল করার পরই শুরু হয় এক বড় দমন-পীড়ন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে মূলধারার রাজনৈতিক দলের নেতারাও ছিলেন—এমনকি তারাও ছিলেন, যারা কাশ্মীরকে ভারতের অংশ বলেই মনে করেন। ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কাশ্মীর কার্যত বিশ্বের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তবুও মোদী সরকার দাবি করেছিল, এই কষ্ট সাময়িক। তারা বলেছিল, এর মাধ্যমে কাশ্মীরে ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সরকারের একাধিক কর্মকর্তা তখন এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘স্বাভাবিকতা’ হিসাবে।
তবে এই সময়ের পরও সাধারণ মানুষ, এমনকি সাংবাদিকদেরও গ্রেপ্তার করা অব্যাহত ছিল। নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠনের মাধ্যমে এমনভাবে সীমানা নির্ধারণ করা হয়, যাতে হিন্দু-অধ্যুষিত জম্মু অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যায়। আর মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার প্রভাব কমে যায়।
২০১৯ সালের আগে যা অনুমোদিত ছিল না, সেই নিয়ম ভেঙে এখন বহিরাগতদের সেখানে বসবাসের অধিকার দিয়ে বসবাসকারি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। এতে কাশ্মীরের জনসংখ্যাগত কাঠামো বদলানোর চেষ্টার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে কাশ্মীরে এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর সরকারকে অন্যান্য রাজ্য সরকারের মতো পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বরং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হচ্ছে দিল্লি থেকেই।
এই সবকিছুর মধ্যেই মোদী সরকার কাশ্মীরে পর্যটন প্রচারে জোর দেয়। তারা দাবি করে, পর্যটকসংখ্যা বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে দীর্ঘ চার দশকের সশস্ত্র আন্দোলনের পর অঞ্চলটিতে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩৫ লাখ পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে পহেলগাম হামলার অনেক আগেই, ২০২৪ সালের মে মাসে তখনকার বিরোধী নেতা ও বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, পর্যটকের সংখ্যা দিয়ে কাশ্মীরের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বোঝা উচিত নয়।
তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। পর্যটনকে স্বাভাবিকতার মানদণ্ড হিসেবে তুলে ধরা উচিত নয়। কারণ, স্বাভাবিকতা আর পর্যটনকে একসূত্রে গাঁথা হলে পর্যটকদের ঝুঁকির মুখে ফেলা হয়। আপনি পর্যটকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দিচ্ছেন।”
আল জাজিরা এবারের সঙ্কট নিয়ে ওমর আবদুল্লাহর মতামত জানার চেষ্টা করেছে। তবে এখনও তার পক্ষ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
আন্তর্জাতিক সঙ্কট বিশ্লেষণকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি বলেন, এপ্রিলের ২২ তারিখের হামলাই সেই ভয়াবহ পরিণতি, যার বিষয়ে আবদুল্লাহ আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন।
তিনি বলেন, “নয়া দিল্লি ও তাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নিজেদেরই তৈরি করা শান্তি ও স্থিতিশীলতার ধারণা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল, সশস্ত্ররা আর কখনও পর্যটকদের ওপর হামলা চালাবে না।”
দোন্থি আরও বলেন, “পহেলগাম হামলার আগ পর্যন্ত সশস্ত্ররা সাধারণত পর্যটকদের টার্গেট করত না। কারণ তারা বুঝত, পর্যটকরা এই অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারা যদি চাপে পড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন মাত্র দুজন বন্দুকধারীই যথেষ্ট এটা প্রমাণ করার জন্য যে কাশ্মীর মোটেই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।”
কাশ্মীর ও পাকিস্তান নিয়ে মোদী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
গত ৮ এপ্রিল, অর্থাৎ পহেলগাম হামলার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরের বৃহত্তম শহর শ্রীনগরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনার একটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মোদীকে ঘনিষ্ঠজন অমিত শাহকে তার ডেপুটি হিসেবেই দেখা হয়।
কিন্তু কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে ওই বৈঠকে রাখা হয়নি। এটি ছিল সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, যেখানে তাকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পর্যালোচনা থেকে বাইরে রাখা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেয় যে মোদী সরকার কাশ্মীরের নিরাপত্তা সঙ্কটকে মূলত একটি পররাষ্ট্র নীতির সমস্যা হিসেবে দেখে, যা পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার অংশ। এই সমস্যা তারা ঘরোয়া রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে না।
ভারত বহুদিন ধরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে, তারা কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ জোগান দিচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করে, তারা কেবল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেয়।
আন্তর্জাতিক সঙ্কট বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি বলেন, পহেলগাম হামলা মোদী সরকারের এই নীতির ভুল দিকটি স্পষ্ট করে তুলেছে।
তিনি বলেন, “এই ঘটনাকে শুধু পাকিস্তান দ্বারা প্ররোচিত একটি নিরাপত্তা সঙ্কট হিসেবে তুলে ধরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। কিন্তু এটি কখনোই সমস্যার সমাধানে সাহায্য করবে না। যতক্ষণ না ভারত সরকার কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে কার্যকর সংলাপে যুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ এই সহিংসতার কোনও স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”
তবে এখন পর্যন্ত কোনও লক্ষণ নেই যে মোদী সরকার তার কৌশল বদলাতে যাচ্ছে। বরং বিশ্লেষক শেখ শওকত বলেন, সরকারের বর্তমান কৌশল ‘দেশপ্রেম ও চরম জাতীয়তাবাদী বক্তব্যকে সন্তুষ্ট করতেই’ গঠিত।
পহেলগাম হামলার পর থেকেই মোদী সরকারের দৃষ্টি পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার দিকে।
১৯৬০ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) চালু রয়েছে, সেটি তিনটি যুদ্ধ টিকে গেছে এবং আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে এক সফল উদাহরণ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে।
এই চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর মধ্যে ভারত পায় পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদী—রবি, বেয়াস ও শতদ্রু—আর পাকিস্তান পায় পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী—সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব। এই তিনটি নদী পাকিস্তানে প্রবাহিত মোট পানির ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে।
কিন্তু পহেলগাম হামলার পর ভারত এই চুক্তি থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে। এর ফলে চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ভারত পানি বন্ধ বা অন্য দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলে সেটি ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ শামিল হবে। ইসলামাবাদ আরও বলেছে, তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থেকেও সরে যেতে পারে। এই শিমলা চুক্তিই মূলত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্য ফ্যাক্টো সীমান্ত লাইন অব কন্ট্রোল নির্ধারণ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন্ত্র বোস বলেন, “পাকিস্তান এই পানির ক্ষতিকে সত্যিকারের অস্তিত্ব সংকট হিসেবে দেখে। এমনকি ধ্বংসাত্মক পরিণতির শঙ্কাও করে। ভারত তা জানে—এবং তাই এটি একপ্রকার সম্মিলিত শাস্তিমূলক নীতি, যার প্রভাব পড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা এই দুই দেশের ঘোষণার বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তারা বলছেন, ভারত কি আদৌ এই বিশাল নদীগুলোর প্রবাহ বন্ধ করতে সক্ষম? ভারত কি এই পানি অন্যদিকে চালাতে পারবে, যেখানে নিজ ভূখণ্ডেই ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে? আর পাকিস্তান যদি শিমলা চুক্তি বাতিল করে, তাহলে কি এটি কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা বলে বিবেচিত হবে?
সুমন্ত্র বোস বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো দুই পক্ষের কাছ থেকেই অন্যায় ও বালখিল্য আচরণ। তবে এগুলোর বাস্তবিক প্রভাব অনেক গভীর।”
ভারতের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছিল, তারা সিন্ধু পানি চুক্তি পুনর্বিন্যাস করতে চায়। কারণ তারা মনে করে, এই চুক্তিতে ভারত ন্যায্য হিস্যা পায় না। কাশ্মীর ইস্যুতে সাম্প্রতিক উত্তেজনা নয়াদিল্লিকে এখন এই চুক্তি বাতিল করার জন্য একটি সুযোগ ও অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন কাশ্মীরভিত্তিক বিশ্লেষক শেখ শওকত।
মোদী কি কাশ্মীর নীতি বদলাবেন
পহেলগাম হামলার দুই দিন পর মোদী ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে নির্বাচনী সফরে যান। এই রাজ্যে চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হওয়ার কথা। এক নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, তিনি হামলাকারীদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করবেন।
মোদী জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, এমন বক্তব্য আসলে মোদীর কাশ্মীর নীতির প্রকৃত উদ্দেশ্যই তুলে ধরে। তিনি বলেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে বিজেপি দেশের অন্যান্য অংশে তাদের প্রধান ভোটব্যাংককে আরও সক্রিয় করতে চায়—এটাই মোদীর কাশ্মীর নীতির মূল লক্ষ্য।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বিজেপির আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) কাশ্মীরকে একটি অসমাপ্ত প্রকল্প হিসেবে দেখে এসেছে। বহু দশক ধরে তারা দাবি করেছে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা উচিত এবং মুসলিম-অধ্যুষিত এই অঞ্চল শক্ত হাতে শাসন করা প্রয়োজন।
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, “এখন একটাই কথা চলছে—‘আমরা প্রতিশোধ চাই’। এটা এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা বর্তমানে ভারতে প্রধান হয়ে উঠেছে।”
পহেলগাম হামলার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কাশ্মীরি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। বাড়িওয়ালারা কাশ্মীরি ভাড়াটিয়াদের ঘর থেকে বের করে দিচ্ছেন। মুসলিম রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। সোশাল মিডিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি বলেন, পহেলগাম হামলা এক অর্থে মোদী সরকারের জন্য ‘একটি শক্তি সঞ্চারকারী ঘটনা’। যদিও কাশ্মীরে নিরাপত্তা সঙ্কট ও পাকিস্তানের সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনা কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিকভাবে জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, “তবুও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এটি মোদী সরকারের জন্য এক অনুকূল পরিস্থিতি।”
তিনি বলেন, এই অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে কারণ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল এবং মূলত সরকারের লাইনেই হাঁটছে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন্ত্র বোস মনে করেন, মোদী সরকার শুধু তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিহারে মোদীর মন্তব্য এবং কাশ্মীরি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে টেলিভিশন চ্যানেল ও সোশাল মিডিয়ায় ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিস্তার—সবই বিজেপির কাশ্মীর বিষয়ে বিস্তৃত আদর্শিক অবস্থানের প্রতিফলন।
সুমন্ত্র বোস বলেন, কাশ্মীর মোদী সরকারের কাছে একটি আদর্শিক যুদ্ধক্ষেত্র। “এই সরকার কখনোই তাদের কাশ্মীর নীতি বদলাবে না,” জোর দিয়ে বলেন তিনি।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা