কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপের মুখোমুখি হননি এমন মানুষ বিরল। পেশাগত জীবনে চাপের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ক্রমাগত মানসিক চাপে ভুগতে থাকাও স্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ এমন চাপ স্বাভাবিক জীবন থেকে যে কাউকেই ঠেলে দেয় দূরে। ব্যক্তিকে করে তুলে অসহায়। মনে তৈরি হয় উদ্বেগ, আশঙ্কা আর ভয়ের অনুভূতি।
মনের এমন পরিস্থিতিকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘অ্যাংজাইটি ডিজওর্ডার’, যা কিনা উদ্বেগজনক অনুভূতির একটি চরম অবস্থা।
কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগের এমন অনুভূতি কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকেই এমন উদ্বেগের বশবর্তী হয়ে কর্মক্ষেত্রে নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এমনকি কাজ বেড়ে যাবে, এই ভয় আর ব্যর্থতার আশঙ্কায় পদোন্নতি পর্যন্ত নাকচ করে দেন।
কাজের পরিসরে এমন চরম উদ্বেগ বা ‘ওয়ার্কপ্লেস অ্যানজাইটি’ থাকে তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা যাবে। যেমন- বন্ধুবান্ধব এবং পারিবারিক আড্ডা এড়িয়ে যাওয়া, সার্বক্ষণিক ভীতি, কান্না পাওয়া, সবসময় মেজাজ খিটখিটে থাকা, ক্লান্ত ও দুশ্চিন্তা বোধ করা, নিজের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে হয়ে পড়া, ঘুম ঠিকমত না হওয়া, মনযোগে ঘাটতি ও স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, কাজে আগ্রহ কমে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া অথবা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগ কেন তৈরি হয়
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো কর্মপরিবেশ নিয়ে সচেতন দেশে, অনেকেই ভুগছেন কর্মকালীন উদ্বেগ জটিলতায়। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর ওয়ার্কপ্লেস মেন্টাল হেলথ এর মতে, কর্মক্ষেত্রে চরম উদ্বেগ আমেরিকার একটি সাধারণ সমস্যা।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডার্সি গ্রুতাদারোর মতে, কর্মক্ষেত্রে অ্যাংজাইটি ডিজওর্ডার কিংবা চরম উদ্বেগে ভোগা ব্যক্তির থাকবে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য-
- কাজের মানে অবনতি
- ঘন ঘন অফিস কামাই
- কাজে আন্তরিকতা না থাকা
- ঘামানো, পেটে সমস্যা এবং কম ঘুম
কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কারও কারও জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করা, অতিরিক্ত চাপ, কাজে ম্যানেজার এবং সহকর্মীদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতার অভাব উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় চরম উদ্বেগ তৈরি করতে পারে-
- সমাধান হয়নি এমন কোন বিষয়
- প্রেজেন্টেশন দেওয়া
- কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক
- মিটিং, সহকর্মীদের সঙ্গে খেতে বসা এবং অফিস পার্টি
- ডেডলাইন
- মিটিং-এ কথা বলা
তবে আশার বিষয় হলো উদ্বেগ এবং চাপ কমানো কোন অসম্ভব বিষয় নয়।
এ ব্যাপারে ক্লিনিকাল সাইকোলোজিস্ট ডেব্রা কিসেনের পরামর্শ হলো, কোন কোন বিষয়গুলোতে উদ্বেগ তৈরি হয় সেগুলো একটি ডায়রি কিংবা খাতায় লিখে রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে কোন মুহূর্তগুলোতে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে সেগুলোও লিখে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, “উদ্বেগ তৈরি হওয়ার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন দিনের শুরুতে এটি বেশি অনুভূত হতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এটি দিনের শেষ বেলায়।”
কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করার কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা-
স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন
ঘুমাতে হবে পর্যাপ্ত। খেতে হবে স্বাস্থ্যকর খাবার। বাদ দিতে হবে মদ্যপান এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন।
নিজের প্রতি সৎ থাকা
হাতে যথেষ্ট সময় এবং আগ্রহ না থাকলে অতিরিক্ত কাজ নিজের ঘাড়ে নেওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতি হলে আন্তরিকভাবে ‘না’ বলার চর্চা করে নিজের ওপর চাপ কমাতে হবে।
সহযোগিতার কথা খুলে বলা
কর্মক্ষেত্রে কাজে নিরন্তর অসুবিধার সম্মুখীন হলে ম্যানেজারকে খুলে বলাই শ্রেয়। এমন তো হতেই পারে; কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মী যে সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছেন তা আদৌ তার ম্যানেজারের নজরে নেই।
সাফল্য উদযাপন
প্রতিটি কাজ শেষ করার পরার তার ইতিবাচক দিকগুলোতে দিতে হবে মনযোগ, উদযাপন করতে হবে সাফল্য।
পরিকল্পনা
বড় কাজগুলো শুরু করতে হবে যথাযথ সময়ে। কাজকে কয়েক ভাগে ভাগ করে নির্ধারণ করতে হবে ছোট ছোট লক্ষ্য। আর লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।
নিজের চারপাশে সীমারেখা
বাড়িকে অফিসে নিয়ে আসা যাবেনা, তেমনি অফিসের কাজ নেওয়া যাবেনা বাসায়। বাড়ির কোন স্পর্শকাতর ইস্যু যেমন অফিসে আলাপ করা যাবে না, তেমনি অফিসের অভ্যন্তরীণ বিষয় ঘরে আলাপ করা মানা।
টক্সিক সহকর্মীদের ব্যাপারে সাবধানতা
টক্সিক সহকর্মীদের ব্যাপারে থাকতে হবে সচেতন। তারা যেন জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে কোনভাবেই ঢুকে যেতে না পারে। তাদের সঙ্গে অফিসে কাজের বাইরে অন্য কোন আলাপ একেবারেই করা যাবে না।
বিশ্রাম
টানা কাজে তৈরি হয় চাপ এবং উদ্বেগ। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিতে হবে ব্রেক। এমনকি মাঝে মাঝে অফিস থেকে ২-৩ দিনের ছুটি নিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।