অনেক সময়ই এরকম হয়, শরীরের একটি নির্দিষ্ট জায়গার চর্বি কমানোর প্রতি আমাদের মনযোগ দিতে হয়। এ লড়াইয়ে পেটের চর্বি কমানোর দিকেই নজর বেশি থাকে। নারীদের মধ্যে যারা স্লিভলেস জামা পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদের অনেকেই পেটের চর্বির পাশাপাশি হাতের বাহুর চর্বির কমানোর দিকেও জোর দেন।
তবে মানুষের মুখের চর্বি কমানো মনে হয় সবচেয়ে কঠিনতম সংগ্রামের একটি। গালের এই নিচের অংশটি চেহারায় বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং মুখের পেশীগুলোর নড়াচড়াতেও এর রয়েছে বিশেষ অবদান। আর সেই কারণেই হয়তো চেহারার চর্বি কমানোর কসমেটিক সার্জারি সারা পৃথিবীতেই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কোভিড মহামারী চলার সময়ে বাড়িতে থেকেই ওজন কমানোর ব্যায়ামগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সোশাল মিডিয়ায় তখন এ সংক্রান্ত ভিডিওগুলো ভাইরাল হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বাড়িতে বসে চর্চা করতেও শুরু করেন।
দ্রুত ওজন কমানোর টিপসের মধ্যে তখন থেকেই মুখের ম্যাসাজ, মুখের যোগব্যায়াম এবং চীনা পদ্ধতি গুয়া শা-র মতো চর্বি কমানোর পদ্ধতিগুলোর ভিউয়ারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, গুয়া শা হলো মুখে একটি মসৃণ শক্ত বস্তু দিয়ে চেপে গালের একইদিকে ক্রমাগত ম্যাসাজের পদ্ধতি।
পরে আরও নতুন নতুন গাল ম্যাসাজের পদ্ধতি আসে। গালের চর্বি কমাতে ‘লিম্ফ্যাটিক ড্রেনেজ’ এবং ‘কর্টিসোল ফেইস’- এরকম দুইটি পরিচিতি পাওয়া বিশেষ ম্যাসাজ। বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে নানা টিপস দিতে শুরু করেন। কিন্তু মুখের চর্বি কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় আসলে কী?
চেহারার চর্বি কমানোর সেরা উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে মুখের চর্বি কমানো বেশ জটিল। তারা বলছেন, পুরো শরীরের ওজন কমানোর প্রক্রিয়াই একমাত্র চেহারার চর্বি কমাতে পারে।
ভারতের আহমেদাবাদের ফিট অ্যান্ড ফিটনেস কোম্পানির ফিটনেস বিশেষজ্ঞ পাথিক প্যাটেল বলেন, “মানুষ পুরো শরীরের ওজন কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখে এবং এটি ডায়েটের মধ্য দিয়ে অর্জন করা যায়। নিয়মিত ব্যায়াম ও সঠিক ডায়েটের সমন্বয়ে শরীরের চর্বি কমানোর পাশাপাশি মুখের চর্বিও কমে যায়। যার ফলে শরীর ও মুখ সুন্দর হয়।”
তিনি যোগ করেন, “আমি নিয়মিত দৌড়াই, সাইকেল চালাই বা অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম করি। এই ধরনের ক্রিয়াকলাপ চর্বি পোড়াতে, বিপাক বাড়াতে এবং ক্যালরি কমাতে সাহায্য করে।”
পথিক আরও বলেন, “শরীরে জলীয় উপস্থিতি বা হাইড্রেটেড থাকা একটি কার্যকর উপায়। শর্করা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিমিত সোডিয়াম জাতীয় খাবার কম গ্রহণের মধ্য দিয়ে শরীরে জলীয় ভাব ধরে রাখে, যা মুখের ফোলাভাব কমাতে পারে।”
হিমালয় সিদ্ধা অক্ষর একজন যোগ-বিশেষজ্ঞ। অক্ষর যোগ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা হিমালয় বলেন, মুখের যোগব্যায়ামে নির্দিষ্ট ভঙ্গি এবং প্রাণায়াম কৌশল রয়েছে যা মুখে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে।
তার মতে, এ যোগব্যায়াম কোনও ধরনের প্রসাধনী না নিয়েই চেহারায় উজ্জ্বল আভা এবং সুগঠন অর্জনে সহায়তা করে।”
সহজভাবে বললে, ব্যায়াম ও ডায়েট একইসঙ্গে করার মাধ্যমেই চেহারার ফোলা ভাব বা মেদ কমানো সম্ভব। এই তালিকায় অবশ্যই যোগব্যায়ামও রয়েছে।
মুখের ম্যাসাজ প্রসঙ্গে
সাধারণত রক্ত ও হরমোন সঞ্চালন বৃদ্ধি, মানসিক উত্তেজনা কমানো এবং চেহারায় উজ্জ্বলতার উপায় হিসেবে প্রমোটররা মুখের ম্যাসাজ এবং ব্যায়ামগুলোর কথা প্রচার করেন।
তবে ভুল পদ্ধতিতে বা অতিরিক্ত এসব করা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনিবার্য বলে আসামের একজন চিকিত্সক শ্যামসুন্দর শর্মা জানান।
তিনি এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার একটি তালিকাও করেছেন।
বলি রেখা বৃদ্ধি
যদি মুখের ব্যায়াম পুনরাবৃত্তিমূলক বা ব্যায়ামের জন্য অতিরিক্ত নড়াচড়া করা লাগে তাহলে বলিরেখার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে চোখ এবং মুখের মতো সূক্ষ্ম রেখাপ্রবণ এলাকার এই বলিরেখা বয়সের ছাপ ফেলতে পারে।
মাথাব্যথা
ডাঃ শর্মা বলেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে শরীরের অন্যান্য পেশীর মতোই মুখের পেশীগুলোও ক্লান্ত বা আঁটসাঁট হতে পারে। এটি অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে মাথাব্যথা হতে পারে।
চোয়ালের ব্যথা
চোয়ালের নড়াচড়ার সঙ্গে জড়িত ব্যায়াম কখনও কখনও চোয়ালের অস্বস্তি বা এমনকি টিএমজে (টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্ট ডিসঅর্ডার) এর মতো অবস্থাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার ফলে ব্যথা বা শক্ত হয়ে যায়।
ত্বকের জ্বালা
মুখের ব্যায়ামের সময় টানটান হয়ে থাকা ত্বক আরও সংবেদনশীল হয়। ফলে ত্বকে জ্বালা বা লালভাব দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে যাদের ত্বক সূক্ষ্ম বা পাতলা তাদের।
আমেরিকান মডেল কেন্ডাল জেনার থেকে ভারতীয় সুপারস্টার দীপিকা পাডুকোন পর্যন্ত চেহারার নবীন ও সজীব ভাব ধরে রাখতে গুয়া শা বা জেড রোলার দিয়ে মুখ ম্যাসাজের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেন। এখন অনেক সৌন্দর্য উৎসাহীদের ত্বকের যত্নের রুটিনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে এসব।
পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে। গ্লোবাল স্কিনকেয়ার ডিভাইসের বাজারের আকার ২০২২ সালের ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছিল। ২০২৩ সালে সেটি ১ হাজার ৫৩০ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।
এই সরঞ্জামগুলো চেহারার চর্বি কমানোর সরঞ্জাম হিসেবে প্রচারিত ও বাজারে বিকিকিনি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কিছু সময়ের জন্য হয়তো কাজ করে। তবে দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে।
২০১৮ সালে ৫০ জন নারীর ওপর চালানো ‘পাও ডিভাইস’ ব্যবহারের এক সমীক্ষা চালানো হয়। ‘পাও ডিভাইস’ হলো মুখের চর্বি কমানোর একটি যন্ত্র যেটির মূলত পাখির মতো দুইটি ডানা থাকে। মুখে সেটির মধ্যভাগ দিয়ে ঝাঁকালে দুইপাশের ডানা পাখি ওড়ার মতো নড়তে থাকে। এতে মুখে চাপ পড়ে এবং ব্যায়াম হয়।
ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এটি মুখের পেশীর পুরুত্ব বাড়ায় এবং দুই পাশের পেশীর কার্যকারিতাও বাড়ায়। আর এভাবে মানুষের চেহারাকে দেয় তারুণ্য।
তবে চিকিৎসক শর্মা বলছেন, চেহারার মেদ কমানোর এসব সরঞ্জামগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়নি। আর এগুলো নিয়ে আসতে পারে সংবেদনশীল ত্বকের মানুষের ব্রণ, পাতলা ত্বকের মানুষের রক্তনালী ভেঙে যাওয়ার মতো ইনজুরি এবং রোসেসিয়া বা একজিমার রোগীর বাড়তি ভোগান্তি।
মনে রাখবেন
মুখের চর্বি কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের সামগ্রিক ওজন হ্রাস করা। পাশাপাশি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নেয়া।