যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে ফিরেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভূরাজনৈতিক শৃঙ্খলা পাল্টে দিতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে লাভ-ক্ষতি অনেক কিছুই হতে পারে। তবে সম্ভাব্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার, যার ইঙ্গিত এরইমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
ধনকুবের ট্রাম্প আসার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুল্কের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র নীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে।
বিপরীতে ইউরোপের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ বেড়েছে। ডলারের মান ইউরোর তুলনায় দ্রুত কমেছে। ইউরোপের শেয়ারবাজার নতুন রেকর্ড করেছে এবং জার্মানির বন্ডের সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ডলার সূচক গত নয় সপ্তাহের মধ্যে সাত সপ্তাহেই কমেছে। এতে গত ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের পর অর্জিত লাভ প্রায় হারিয়ে গেছে। এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবাহ থেকে শুরু করে ট্রান্স আটলান্টিক পর্যটনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থায় ডলারকে শক্তিশালী করার প্রয়াসে ছিলেন।
এর একটি কারণ হলো, এটি সরকারের ঋণ নেওয়া সহজ ও সস্তা করে। দেশটির প্রতিরক্ষা খরচ এই অবস্থানকে শক্তিশালী করে। কারণ এটি বাজেট ঘাটতি বাড়িয়েছে। এই ঘাটতির বড় অংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পূরণ করেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ধারণ করেন।
তবে এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার কিছু উপদেষ্টা স্পষ্ট করেছেন যে, তারা মিত্র দেশগুলোর সুরক্ষায় কম ব্যয় করতে চান। পাশাপাশি তারা দুর্বল ডলার চান, যাতে দেশীয় উৎপাদন বাড়ে এবং বিদেশি ক্রেতাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য সস্তা হয়।
গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক সিইও লয়েড ব্ল্যাঙ্কফেইন বলেন, “সামগ্রিকভাবে এই নীতিগুলো দেখলে এতে একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি দেখা যাবে। স্বল্পমেয়াদে বাজারের জন্য ঝুঁকি হলো অস্থিরতা। তবে আমরা গাড়ির জন্য কয়েক হাজার ডলার বেশি খরচ করলে আমাদের কর্মীরা পণ্য তৈরি করতে ও তা কেনার সামর্থ্য অর্জন করে। আর এতে আমাদের দেশ দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে।”
তবে ওয়াল স্ট্রিটের অনেক বিশেষজ্ঞ এই পরিবর্তনের নেতিবাচক দিক নিয়ে উদ্বিগ্ন। দুর্বল ডলার আমদানি খরচ বাড়াবে। এতে মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হবে এবং ফেডারেল রিজার্ভের জন্য সুদের হার কমানো কঠিন করে তুলবে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ থেকে বিনিয়োগ সরলে ডলারের মান আরও কমতে পারে। আর এমনটা হলে পুঁজিবাজারে মন্দা নেমে আসতে পারে। পাশাপাশি দেশের ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে।
ডলারের মূল্য দ্রুত ও ব্যাপকভাবে কমবে, এটা অবশ্য অনেকে মনে করেন না। এর একটি কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার অধিকাংশ উন্নত দেশের তুলনায় বেশি। এতে বিদেশি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে নর্দার্ন ট্রাস্ট ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা কেটি নিক্সন বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহের পরিবর্তন পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।”
সম্প্রতি ডলারের পতন বিনিয়োগকারীদের অবাক করেছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ট্রাম্প মূলত ঐতিহ্যবাহী রিপাবলিকান নীতিতে চলবেন। যেমন কর কমানো ও নিয়ম-কানুন শিথিল করা এমন কিছু।
নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পর দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এবং সামান্য বেশি শুল্কের কারণে পুঁজিবাজার ও ডলারের মান শুরুতে বেড়েছিল।
এখন বিনিয়োগকারীরা তাদের আগের ধারণা নতুন করে বিবেচনা করছেন। ট্রাম্প এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন এবং আরও শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছেন। এতে কানাডা ও চীন দ্রুত পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন হাজারো সরকারি কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। কর কমানোর আলোচনা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।
এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা কমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা শুধু শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবেই নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত অনিশ্চয়তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। কারণ শুল্ক বাড়লে ভোক্তা পণ্যের দামও বাড়তে পারে।
বিপরীতে ইউরোপের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ বাড়ার একটি কারণ হলো সাম্প্রতিক ইতিবাচক অর্থনৈতিক তথ্য। পাশাপাশি এটি ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে প্রকাশ্য বিরোধের পর ইউরোপের সামরিক খরচ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলও।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা কঠিন হতে পারে- এমন আশঙ্কায় জার্মান নেতারা কয়েকদিনের মধ্যেই ঐতিহ্য ভেঙে সামরিক খাতে অর্থায়নের জন্য ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা শত শত বিলিয়ন ইউরো সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। এটি প্রতিরক্ষা খাতের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে আর্থিক নিয়ম শিথিল করার উদ্যোগের অংশ।
বিনিয়োগকারীদের জন্য এসব ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
গত কয়েক দশকে ইউরো কিছু সময়ের জন্য ডলারের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছে। তবে এবার এই প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ ইউরোপ যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা একবারের জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে। কারসন গ্রুপের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষক সোনু ভার্গিসের মতে, এটি কোভিড প্রণোদনার মতো স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ নয়।
এখন পর্যন্ত ডলারের মান কিছুটা কমেছে। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের জন্য বড় কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তবে এই পদক্ষেপটি ওয়াল স্ট্রিটের নজর আকর্ষণ করেছে। কারণ এটি ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ট্রাম্প প্রায়ই বলেন, ডলারের দুর্বল হওয়া উচিৎ। গত বছর তিনি দাবি করেছিলেন, ডলারের শক্তি ‘আমাদের প্রস্তুতকারকদের জন্য বিপর্যয়কর’।
হোয়াইট হাউস অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের বর্তমান স্টিফেন মিরান গত বছর এক প্রতিবেদনে ট্রাম্পের ডলার দুর্বল করার কিছু অপ্রথাগত ধারণা পেশ করেন। এর মধ্যে ছিল বিদেশি ক্রেতাদের ওপর ট্রেজারি বন্ড কেনার জন্য একটি ব্যবহার ফি আরোপ করার প্রস্তাব।
কিছু ওয়াল স্ট্রিট বিশ্লেষকরা এই ধারণাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। ভোয়া ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিনিয়োগ প্রধান এরিক স্টেইন বলেন, সম্প্রতি ডলারের দুর্বলতার একটি কারণ হলো বিনিয়োগকারীরা জানেন প্রশাসনের লক্ষ্য কী।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ট্রাম্পের নীতি অনুযায়ী পরিস্থিতি চলবে না।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো ব্র্যাড সেটসার এর একটি কারণ হিসাবে বলেন, ট্রাম্পের কর কমানোর প্রতিশ্রুতি সম্ভবত ফেডারেল বাজেট ঘাটতিকে বড় রাখবে। ঘাটতি পূরণে আরও ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বাড়িয়ে দিতে এবং ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা উচ্চ সুদের সম্পদ খুঁজে বেড়ায়।
অন্য একটি পরিস্থিতিতে, ডলার দুর্বল হতে থাকলে ট্রাম্প তার লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ও আমদানি ব্যবধান কমানো—পূরণ করতে পারেন। তবে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার কারণে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ থেকে অর্থ স্থানান্তর করতে চাইতে পারেন। তবে ইউরোপসহ বিকল্পগুলোরও নিজস্ব সমস্যা রয়েছে।
ক্লিনটন প্রশাসনের অর্থমন্ত্রী ও গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক কর্মকর্তা রবার্ট রুবিনের মতে, “এ সব কিছুই অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। বিদেশি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাবে?”
তথ্যসূত্র : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল